‘জয় যেন বাংলাদেশের হয়'
২৮ ডিসেম্বর ২০১৮আলোচনায় অংশ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন, ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী৷
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণার শেষ দিনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে বক্তারা নির্বাচন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন৷
আলোচনার শুরুতেই নূহ-উল-আলম লেনিন ও ডা. জাফরুল্লাহ যার যার অবস্থান থেকে মানুষ কেন তাঁদের দল বা জোটকে ভোট দেবে তার কারণ ব্যাখ্যা করেন৷ লেনিন বলেন, আওয়ামী লীগ সামগ্রিকভাবে উন্নয়নের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করেছে৷
‘‘আমাদের দারিদ্র্যসীমার নীচে জনসংখ্যার হার ২০০৫-০৬ সালের ৪৫% থেকে নামিয়ে ২২%-এ আনা হয়েছে৷ অতি দরিদ্রের হার ১১%-এ নামানো হয়েছে৷ এগুলো আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং তা বাস্তবায়ন হয়েছে,'' বলেন লেনিন৷
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আওয়ামী লীগ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি এই অভিযোগ এনে বলেন, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতেই ঐক্যফ্রন্টকে ভোট দেয়া উচিত৷
‘‘বঙ্গবন্ধুর মূল কথা ছিল গণতন্ত্র৷ কথা বলতে পারবে৷ সমালোচনা করতে পারবে৷ ওনার সমালোচনা করা যেতো৷ কিন্তু অবজ্ঞা করতেন না মানুষকে৷ অথচ এখন আওয়ামী লীগের লোকেরা মানুষকে অবজ্ঞা, হয়রানি করে,'' বলেন তিনি৷
<iframe src="https://www.facebook.com/plugins/video.php?href=https%3A%2F%2Fwww.facebook.com%2Fdw.bengali%2Fvideos%2F1785110204932044%2F&show_text=0&width=560" width="560" height="315" style="border:none;overflow:hidden" scrolling="no" frameborder="0" allowTransparency="true" allowFullScreen="true"></iframe>
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু জোর দেন ভোটকেন্দ্রে মানুষ যেন যেতে পারেন, তেমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরির দিকে৷
‘‘গত এক মাসের মতো এখনো পরিস্থিতি এমনই আছে যে, মানুষ ভাবছে সে কি শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট দিতে পারবে? আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি ভালো থাকবে? আমি কি ঐরকম একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে গিয়ে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারব?''
সাইফুল আলম চৌধুরী মনে করেন, এক পক্ষ উন্নয়নের কথা বলছে, অন্যপক্ষ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার কথা বলছে৷ এই দুই পক্ষের মাঝে মানুষ আছে সংশয়ের মধ্যে৷‘‘উন্নয়ন আর গণতন্ত্র– একাদশ জাতীয় সংসদের ভোটারদের মধ্যে ‘ডিলেমা' তৈরি করেছে৷ ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি বলছে,গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে তাদের ভোট দিতে হবে৷ কার কাছে গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব দেবো? ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে পেট্রোলবোমা হামলাকারী যুদ্ধাপরাধীদের কাছে দেবো? গণতন্ত্র অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন৷ রক্ষা কঠিনতম জায়গায় ফেলে দেবো? আর উন্নয়নের কথা বললে, যখন মানুষের অধিকার, মৌলিক কিছু অধিকার পাবো না, যখন দুর্নীতি হয় তখন কিন্তু মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন হয়৷ দু' দিকেই এক ধরনের বৈপরীত্য আছে,'' বলেন তিনি৷
তবে লেনিন মনে করেন উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একই ধারায় চলছে৷ তিনি বলেন, ‘‘ডেমোক্রেসি আর ডেভেল্পমেন্টের মধ্যে কোনো চীনের প্রাচীর নেই৷ দুটোকে এক করে দেখতে হবে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি৷ সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রের যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা, তা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ করেছে৷ যেটুকু বাকি ছিল '৭২-এর সংবিধানে ফিরে গিয়ে তা প্রতিষ্ঠা করেছে,'' বলেন এই বর্ষীয়ান নেতা৷
তবে আওয়ামী লীগ যে উন্নয়নের কথা বলছে, তা কতটা গুণগত হয়েছে, তা দেখার অবকাশ আছে বলে মনে করেন সাইফুল আলম৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা যদি শিক্ষাখাত দেখি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগের দশ বছরের চেয়ে বিগত দশ বছরে পরিমাণগত উন্নয়ন হয়েছে অনেক বেশি৷ কিন্তু আসলেই গুণগত উন্নয়ন হয়েছে কিনা তা দেখার অবকাশ আছে৷ সেটা অবশ্য একদিনেই বোঝা যাবে না৷''
এদিকে বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টের আলাদাভাবে ইশতাহার দেয়ার কারণ জানতে চাইলে ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, বিএনপি কেন আলাদা ইশতাহার দিয়েছে তা তাঁর কাছে পরিষ্কার নয়৷ এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি তাদের ইশতাহারে না থাকায় অসন্তোষও প্রকাশ করেন তিনি৷
‘‘ঐক্যফ্রন্টের ইশতাহারে পরিষ্কারভাবে লেখা আছে যে, মানবতাবাদী অপরাধের বিচার অব্যাহত থাকবে৷ তবে সেটা অনন্তকাল নয়, এটাকে এক সময় শেষ করতে হবে৷ সেটা বিএনপি কেন তাদের ইশতাহারে রাখেনি, সেটা ভুল করেছে,'' বলেন জাফরুল্লাহ৷
তবে সরকারকেও এর জন্য দোষারোপ করেন তিনি৷
‘‘কোনো আলাপ আলোচনা করার আগে, যদি আমরা সময় পেতাম, তাহলে আলোচনা করতে পারতাম৷ যেমন আমাদেরটা আমরা তাদের দিয়েছি এক দিন আগে৷ এ কারণেই সময় চেয়েছিলাম৷ হয়তো এ কারণেই হয়েছে,'' মন্তব্য করেন তিনি৷
এদিকে ঐক্যপ্রক্রিয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও পরে আশাভঙ্গ হয়েছে বলে জানান সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন৷
‘‘ঐক্যপ্রক্রিয়া ও ঐক্যফ্রন্ট গঠন এটি কামাল হোসেনেরএকটি সদর্থক রাজনৈতিক ভূমিকা, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য, গণতন্ত্রের প্রশ্নে সমাধানের ভূমিকা পালনের জন্য৷ তাঁদের মধ্যে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন, তাঁরা ১৫-২০ জন আলাদা প্লাটফর্মেই সংসদে যেতে পারতেন, তাহলে জামায়াতের ওপর বিএনপির যে নির্ভরশীলতা, বা এরশাদের ওপর আওয়ামী লীগের নির্ভরশীলতা, সেটি কমে যেত৷ আমরা একটা নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে পারতাম৷ সেদিনই আমার আশাভঙ্গ হলো, যেদিন সবাই এক প্রতীকে নির্বাচনে যেতে রাজি হলেন,'' বলেন তিনি৷
অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে ডা. জাফরুল্লাহ সরকারি দলের পেশীশক্তি প্রয়োগের কারণে ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মীরা প্রচারণা চালাতে পারছেন না বলে অভিযোগ তুললে পাল্টা প্রশ্ন তুলে লেনিন বলেন, ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপির নেতা-কর্মীরা মাঠে আসছেন না৷
‘‘আমি পরশুদিন আমার এলাকায় গিয়েছিলাম৷ সেখানে তো তেমন কোনো ঘটনা ঘটে নাই৷ তাদের তো প্রতিটি ওয়ার্ড ইউনিয়নে নেতা-কর্মী আছেন৷ তাঁরা বেরুচ্ছেন না কেন? পোস্টার লাগাচ্ছেন না কেন?''
জবাবে জাফরুল্লাহ বলেন, ‘‘ধানমন্ডিতে কোনো পোস্টার নাই৷ যখন লাগাতে এসেছে, দাবড়িয়ে দিয়েছে, লাগাতে পারেনি৷ তফসিল ঘোষণার পর পরশুদিন পর্যন্ত গাজীপুরেই ২৬টি নতুন মামলায় ১২৬ জনকে গ্রেফতার করেছে৷ কর্মী কোথায় পাওয়া যাবে?''
সাংবাদিক মঞ্জুও মনে করেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি৷ ‘‘কোনো রকমেই প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য সমতলভূমি তৈরি হয়নি৷ এই নির্বাচনের যে বৈশিষ্ট্য, যা গত ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত চারটি নির্বাচনে ছিল না, তা হলো, গত দশ বছরে একটি সরকার ক্ষমতায়৷ অভিযোগ আছে, আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রশাসনে দলীয়করণ যেহেতু একটি বড় ফ্যাক্টর, তাই সেটি বলবৎ আছে৷ এটি ভারসাম্যহীন,'' বলেন মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু৷
দুই নির্বাচন কমিশনের দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, বিষয়টি আপেক্ষিক৷
‘‘কমিশনের মধ্যেই ডেমোক্রেসি আছে৷ তাঁরা সাংবিধানিক পদে আছেন৷ তার মানে, সেখানে ডেমোক্রেসি আছে৷ আবার নির্বাচন একটি মহাযজ্ঞ৷ এই নির্বাচন কমিশনে যদি ঐক্যমত্য না থাকে, তখন এই মহাযজ্ঞে নানা ধরনের অস্থিরতা থাকে৷ তা বিশেষ করে নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ৷ বাদানুবাদ এমন পর্যায়ে গেছে, যা অপ্রীতিকর,'' বলেন তিনি৷
এছাড়া পর্যবেক্ষক আশানুরূপ না হওয়ায়ও কিছুটা আশাহত হয়েছেন বক্তারা৷ সব মিলিয়ে তাঁরা দেখতে চেয়েছেন এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে মানুষ স্বস্তিতে ও শান্তিতে থাকবে, সহিংসতা বর্জিত নির্বাচনে ভোট দেবে এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ হবে৷ আর ভোটে যেই জিতুক, জিতবে বাংলাদেশ৷
এ বিষয়ে আপনার মতামত লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷