টাকা নাই তো টিকাও নাই!
১৮ ডিসেম্বর ২০২০এরই মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো নিজেদের জনগণের জন্য টিকা কিনে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
এখন পর্যন্ত কেবল বায়োনটেক-ফাইজারের টিকাই আন্তর্জাতিক অনুমোদন পেয়েছে। অ্যামেরিকা, ক্যানাডা এবং যুক্তরাজ্যে টিকার অনুমোদন মিলেছে, টিকা দেয়াও শুরু হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও আগামি সপ্তাহেই এই টিকার অনুমোদন দেয়ার কথা রয়েছে।
একসঙ্গে এত টিকা উৎপাদনে সময় লাগবে। ফলে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, ধনী দেশগুলোই আগে নিজেদের জনগণের জন্য টিকা নিশ্চিত করবে। তারপর হয়তো ধীরে ধীরে দরিদ্র দেশগুলোর দিকে নজর দেয়া হবে।
অথচ এমনটা কি হওয়ার কথা ছিল? যখন থেকে করোনার টিকা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে, ধনী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা তো বটেই, গ্লোবাল ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স- গ্য়াভি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সেপি বারবার বলে আসছে টাকার জন্য যাতে কোনো দেশ টিকা থেকে বঞ্চিত না হয়, সে ব্যবস্থা করবে।
এই তিন সংস্থা মিলে কোভ্যাক্স নামের একটি প্রকল্পও গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের আওতায় ২০০ কোটি টিকা দরিদ্র দেশগুলোর জন্য কেনার পরিকল্পনা করা হয়। বাংলাদেশও কোভ্যাক্সের আওতায় টিকা পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। কিন্তু এখন অর্থ সংকটে আছে প্রকল্পটি, এখনো কোনো চুক্তিও করতে পারেনি। ভবিষ্যতে আদৌ অর্থ জোগাড় সম্ভব হবে কিনা, তা-ও নিশ্চিত বলতে পারছেন না কেউ।
দাতা সংস্থা অক্সফাম কদিন আগেই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, ধনী দেশগুলো উৎপাদন হওয়ার আগেই সম্ভাব্য ৬১ শতাংশ ভ্যাকসিন কিনে রেখেছে। অথচ এই ধনী দেশগুলোতে বাস করেন বিশ্বের কেবল ১৩ শতাংশ মানুষ। এমনকি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একাধিক ভ্যাকসিনও যদি বাজারে আসে, তাহলেও এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
মার্কিন প্রতিষ্ঠান মডার্নার টিকা এখনো অনুমোদন পায়নি। কিন্তু এর খরচ হবে আরো বেশি, প্রতি ডোজ অন্তত ২৫ ডলার। অর্থাৎ, মাথাপিছু ৫০ ডলার। সে হিসেবে এই টিকার জন্য বাংলাদেশের খরচ হবে প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা।
আপাতত বিভিন্ন দেশে অনুমোদন পাওয়া বায়োনটেকের টিকা প্রতি ডোজ ১৯ ডলার ৫০ সেন্ট, অর্থাৎ প্রায় ১৭শ টাকা। প্রতি জনের জন্য দুই ডোজ হিসেব করলে মাথাপিছু খরচ হবে ৩,৪০০ টাকা। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য এই টিকা দিতে হলে খরচ পড়বে কত? প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা!
শুধু টিকার খরচ হিসেব করলেই হবে না। এই টিকা পরিবহন ও সংরক্ষণেও বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বজায় রাখতে হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাংলাদেশের পক্ষে এই ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তাও খুব বাস্তবসম্মত হবে না৷
টিকার গবেষণায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগে বায়োনটেক ও ফাইজারের মুল লক্ষ্যই ছিল এই খরচের কয়েকগুণ বাজার থেকে তুলে আনা। বায়োনটেক জার্মান সরকারের সহায়তা নিলেও ফাইজার মার্কিন সরকারের কাছ থেকেও কোনো সহায়তা নিতে চায়নি। বরং নিজেরাই বিলিয়ন ইউরো খরচ করেছে করোনার টিকা গবেষণায়, যাতে একবার টিকা চলে এলে এর সব মুনাফা প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের অ্যাকাউন্টে জমা করতে পারে। সে কাজে তারা বেশ সফলই হয়েছে বলা যায়।
এদিকে অক্সফোর্ড ও আস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন শুরুতে বেশ এগিয়ে থাকলেও গবেষণা সংক্রান্ত জটিলতায় এখন পিছিয়ে পড়েছে। এই ভ্যাকসিনটির দিকেই মূলত তাকিয়ে ছিল বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দরিদ্র দেশ।
আস্ট্রাজেনেকা তাদের টিকা সর্বনিম্ন মূল্যে বাজারে ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিল। প্রতি ডোজ কেবল তিন থেকে চার ডলার, অর্থাৎ মাথাপিছু দুই ডোজের জন্য খরচ পড়তো ছয় থেকে আট ডলার। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সবাইকে টিকা দিতে খরচ পড়তো কেবল ১১ হাজার কোটি টাকা।
একই সঙ্গে টিকার ফর্মুলা নিজেদের কাছে না রেখে বিশ্বের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভাগাভাগি করায় উৎপাদন ও সরবরাহ করার ক্ষেত্রেও দ্রুততা আনার চেষ্টাও ছিল তাদের।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট এরই মধ্যে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সরবরাহে প্রস্তুতও রয়েছে। তাদের সঙ্গে ভ্যাকসিন কেনার কথা চূড়ান্ত করেছিল বাংলাদেশও।
বাংলাদেশের অর্থনীতি তবুও পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে অনেকটাই ভালো। আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর অবস্থা কী হবে!
এর আগেও ইবোলার মতো অনেক রোগের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন গবেষণা দ্রুতগতিতে এগোয়নি কেবল সেই গবেষণার খরচ আফ্রিকায় ব্যবসা থেকে তুলে আনা সম্ভব হবে না বলে।
২০১৫ সালে পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলা মহামারির পর ‘ভবিষ্যৎ মহামারিতে' আমাদের কী করা উচিত, কী শিক্ষা নেয়া উচিত, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন একটি অনলাইন কোর্সে অংশ নিয়েছিলাম। নানা কিছুর পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ, মাঠ পর্যায়ে কাজ করা কর্মী, চিকিৎসক, ভাইরোলজিস্ট, সবাই একটি বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত ছিলেন ‘পরের মহামারিতে' ভ্যাকসিন দ্রুতই পৌঁছাবে বিশ্বের নানা প্রান্তে।
কিন্তু টাকাই কি শেষ পর্যন্ত শেষ কথা বলবে? দেখা যাক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং মানবাধিকারের ঝান্ডা ওড়ানো দেশগুলো শেষ পর্যন্ত কী অবস্থান নেয়।