1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

টালিউড আবার স্বরূপে-অরূপে ‘স্বরূপে’

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২৯ অক্টোবর ২০২৪

চলচ্চিত্র শিল্পে নয়া সংঘাত। কলাকুশলী ফেডারেশনের সভাপতির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করলেন পরিচালকরা। সভাপতি যৌন হেনস্থার অভিযোগ তুলেছিলেন পরিচালকদের বিরুদ্ধে।

https://p.dw.com/p/4mMbz
নারীর প্রতি যৌন হেনস্থার বিচার পাওয়া এখনও কঠিন৷
প্রতীকী ছবি ছবি: Imago/Reporters

টালিগঞ্জে ফের মুখোমুখি কলাকুশলী সংগঠন ও পরিচালকরা। কয়েকমাস আগে পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়কে সাসপেন্ড করার ঘটনাকে ঘিরে উভয় শিবিরের সংঘাত বেধেছিল। এবার পরিচালকরা একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে আইনি লড়াইয়ের দিকে নিয়ে গেলেন।

মামলার মুখে সভাপতি

ফেডারেশন অফ সিনে টেকনিশিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস। তিনি কিছুদিন আগে মন্তব্য করেন, টালিগঞ্জের ৬০ শতাংশ পরিচালকের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ রয়েছে। তার এই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করে পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টর্স গিল্ড।

গত মাসে পরিচালক অরিন্দম শীলের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তোলেন এক অভিনেত্রী। তিনি বিষ্ণুপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। তার দাবি, পরিচালক একটি ঘনিষ্ঠ দৃশ্য বোঝাতে গিয়ে হেনস্থা করেন। এই ঘটনার পরপরই ডিরেক্টর্স গিল্ড সাসপেন্ড করে অরিন্দমকে। 

‘আমি বলছি না এ ধরনের ঘটনা ঘটে না’

রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ পুজোর আগে একটি সংবাদমাধ্যমে পরিচালকদের একটা বড় অংশের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তুলেছিলেন। এই বিষয়টিকে এবার আদালতে নিয়ে গিয়েছেন পরিচালকরা। ২৩৩ জন পরিচালক আলিপুরের নিম্ন আদালতে স্বরূপের বিরুদ্ধে ২৩ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছেন। যদিও পরিচালক সংগঠন হিসেবে এই মামলার সঙ্গে যুক্ত হয়নি।

সরব পরিচালকরা

মামলাকারীদের মধ্যে রয়েছেন টলিউডের শীর্ষ পরিচালকরাও। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রাজ চক্রবর্তী, অশোক বিশ্বনাথন, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। গিল্ড মামলা না করলেও তার সভাপতি সুব্রত সেন, সম্পাদক সুদেষ্ণা রায় মামলাকারী পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন।

স্বরূপ বিশ্বাসের মন্তব্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন পরিচালকরা। সাবেক সাংবাদিক ও পরিচালক সুদেষ্ণা রায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "স্বরূপ যে কথা বলেছেন, তার সপক্ষে প্রমাণ দেখাতে পারেননি। কানাঘুষো বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো কিছু শুনে সেটা নিয়ে ৬০ শতাংশ পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। আমি বলছি না এ ধরনের ঘটনা ঘটে না। প্রমাণ থাকলে আমরাই ব্যবস্থা নিই। কিন্তু স্বরূপ যা বলেছেন, তাকে তার প্রমাণ দিতে হবে।"

হলিউড থেকে 'মি টু' আন্দোলন বলিউডে পৌঁছেছিল। মুম্বই চলচ্চিত্র শিল্পের অভিনেতা নানা পাটেকার থেকে পরিচালক সাজিদ খান অনেকেই যৌন নিগ্রহে অভিযুক্ত হয়েছেন। তার ছায়া কি টলিউডেও পড়তে পারে? স্বরূপের বক্তব্য কি একেবারেই অমূলক?

পরিচালক অশোক বিশ্বনাথন ডিডাব্লিউকে বলেন, "এই ইন্ডাস্ট্রিতে কলাকুশলী, অভিনেতারা আছেন। এই প্রলোভনের ঘটনা একজন অভিনেতা বা কলাকুশলীও ঘটাতে পারেন। শুধুমাত্র পরিচালক ও প্রযোজকদের চিহ্নিত করা আমাদের কাছে একটা অন্যায় সরলীকরণ বলে মনে হয়েছে। আমরা সেই জন্যই মামলা করেছি।"

চলতি বিতর্কে স্বরূপ বিশ্বাসের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এর আগে গত আগস্টে তার নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল সুরক্ষা বন্ধু কমিটি। এই কমিটির লক্ষ্য ছিল টলিউডের নারী কর্মীদের যৌন হেনস্থার প্রতিকার করা

এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বরূপ বলেছিলেন, "চলচ্চিত্র জগতে নারীদের উপর অত্যাচার সহ্য করবে না ফেডারেশন। কেউ অভিযোগ তুললে তার পাশে থাকব। সাড়ে আট হাজার কলাকুশলীর হয়ে বলছি, ভয় পাবেন না। এগিয়ে আসুন, অভিযোগ জানালে আপনার লড়াই আমরা লড়ব।"

হেনস্থার ছবি সর্বত্র

সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীদের হেনস্থা হওয়ার নজির অহরহ মেলে। চলচ্চিত্র জগত থেকে রাজনীতি, কিছুই বাদ পড়ে না। সিপিএমের সাবেক বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য দিন দুয়েক আগেই এক নারী সাংবাদিককে শ্লীলতাহানির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। 

চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এই ধরনের পরিবেশ যে রয়েছে তার প্রমাণ দিচ্ছে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের বয়ান। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে সম্প্রতি সোচ্চার হয়েছিলেন ঋতাভরী চক্রবর্তী। রূপাঞ্জনা মিত্র, অনীক দত্ত, পিঙ্কি বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজয় প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়রাও তাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।

আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যখন চরমে, তখন টলিউডে কাজের পরিবেশ ঠিক রাখার দাবি জানিয়ে ইম্পা, আর্টিস্ট ফোরাম, ফেডারেশন ও টেলি অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছিল উইমেনস ফোরাম ফর স্ক্রিন ওয়ারকার্স। 

আর জি কর প্রসঙ্গ টেনে টলিউডের সিনেমা, সিরিয়াল ও ওয়েব প্ল্যাটফর্মে কর্মরত নারীদের পক্ষে চিঠিতে লেখা হয়, "প্রত্যেকদিন আমাদের নানা ভাবে যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয়। আমাদের কাছে এমন কোনও কার্যকরী সহায়তা ব্যবস্থা নেই যেখানে ভারতীয় আইন অনুযায়ী যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, নিষেধাজ্ঞা এবং প্রতিকারের দাবি জানাতে পারি।''

গত বছর ‘শিবপুর' ছবিটি মুক্তির সময় স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, ছবির প্রযোজকের বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ তোলেন। তখন এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়ায় ইম্পা, ও আর্টিস্ট ফোরাম।

আমরা-ওরা বিভেদ?

যৌন হেনস্থার অভিযোগ নেই একথা পরিচালকরা বলছেন না। অশোক বিশ্বনাথনের বক্তব্য, "বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে নারীদের শোষিত হতে হয়। আমাদের চলচ্চিত্র জগতেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। মুম্বইতে হয়েছে, এখানেও হয়েছে। সেদিক থেকে স্বরূপবাবু যেটা বলেছেন, সেটা ভুল নয়। কিন্তু আমাদের আপত্তি এটাতেই যে, উনি বলেছেন এই শোষণ যারা করেন তাদের সিক্সটি পার্সেন্ট পরিচালক বা প্রযোজক। সেটা তো ঠিক নয়।"

কোনো কোনো পরিচালক এর মধ্যে বিভেদকামী মানসিকতাও দেখছেন।পরিচালক প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী ডিডাব্লিউকে বলেন, "একটা পরিবার হিসেবে আমরা কাজ করি। সেই পরিবার শ্রেণীবিভাগ করে ভেঙে ফেলার চক্রান্ত করলে তাকে তো থামাতেই হবে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা-ওরা ছিল না। এটা করতে গিয়ে উনি (স্বরূপ বিশ্বাস) পরিচালকদের ৬০ শতাংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। এই অভিযোগ যদি থেকে থাকে, তাহলে প্রমাণ করার দায় ওরই।"

তার বক্তব্য, "একজন অভিযুক্ত হলে বা তার বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেলে সব পরিচালক কি একই দোষে দুষ্ট হয়ে যান? যে পরিচালক অভিযুক্ত হয়েছেন, তার বিরুদ্ধে অন্যান্য পরিচালকরা একত্রিত হয়েছেন। তা বলে এটা ৬০ শতাংশ নয়।"

অতীত থেকে বর্তমান, সবসময় এই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। সাংবাদিক সাহানা নাগ চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেন, "অতীতেও অভিনয় জগতে নারীরা হেনস্থার মুখোমুখি হয়েছেন, সেটা তাদের আত্মজীবনীতে আমরা পড়েছি। এখন সেটা তারা সামনাসামনি বলছেন। এটা আশার বিষয়, মেয়েরা এখন নিজেদের কথা একটা প্লাটফর্মে বলতে পারছেন।"

কর্মস্থলে নিগ্রহ রুখতে আইন কি রক্ষাকবচ হতে পারে? হেমা কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর দক্ষিণ ভারতের চলচ্চিত্র জগতে বড়সড় বদল ঘটে গিয়েছিল। সাহানা বলেন, "দক্ষিণী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নারীদের উপর হেনস্থা আটকাতে আইন নিয়ে চলে এসেছে। বলিউড এ ব্যাপারে এগিয়েছে। আমি আশাবাদী, টলিউডও আস্তে আস্তে পদক্ষেপ নেবে। আইন যদি পাশ হয়, তবেই কর্মক্ষেত্রে নারীরা সুরক্ষিত থাকবেন।"