টিকটিকির পায়ের প্রযুক্তি আসছে রোবটের পায়ে
২৫ এপ্রিল ২০১১ঘরের মধ্যে আমরা প্রায় টিকটিকি দেখে থাকি৷ সমান দেয়াল বেয়ে কিভাবে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেয়ালের এক কোণ থেকে আরেক কোণে ছুটে যাচ্ছে, কিন্তু পড়ে যাচ্ছে না৷ আবার মৌমাছি কিংবা পোকা মাকড়ও দেয়াল বেয়ে চলা ফেরা করতে পারে৷ কিন্তু কখনো পড়ে যায় না৷ এর রহস্য কী? সেটা জানতে বিজ্ঞানীরা দিনের পর দিন গবেষণা করে যাচ্ছেন৷ তারা জানতে পেরেছেন, অনেক পোকা মাকড়ের শরীর থেকে এক ধরণের রস বের হয় যা তাদেরকে সমান দেয়াল কিংবা কাঁচের ওপর আটকে রাখতে সাহায্য করে৷ সবার বেলায় কিন্তু এরকম হয় না৷ বিশেষ করে টিকটিকির বেলায় সেটি আশ্চর্য রকমের এক ব্যাপার৷
টিকটিকির পায়ের রহস্য
জার্মানির কিল শহরে অবস্থিত ক্রিশ্চিয়ান আলব্রেখ্ট ইউনিভার্সিটির জুওলজিক্যাল ইন্সটিটিউটে এই নিয়ে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানী স্টানিস্লাভ গর্ব৷ গুবরে পোকা, মাকড়সা এবং টিকটিকি কিভাবে দেয়ালে শক্তভাবে আটকে থাকে এবং সহজেই চলাফেরা করতে পারে তা তিনি উদঘাটন করেছেন৷ গবেষকরা ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে দেখতে পেয়েছেন যে, টিকটিকির পায়ের তালুর চামড়ার নীচে রয়েছে হাজার হাজার ভাঁজ৷ সেই ভাঁজের মধ্যে রয়েছে কোটি কোটি লোমের গুচ্ছ৷ এবং সেই একেকটি গুচ্ছ আবার মিলিয়ন মিলিয়ন তন্তুর সমন্বয়ে গঠিত যেগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম ‘সিটেই'৷
একেকটি ‘সিটেই' ২০০ ন্যানোমিটার পুরু এবং মাথাটা চ্যাপ্টা, যেগুলো একমাত্র ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করেই দেখা সম্ভব৷ পর্যবেক্ষণে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, যে এইসব ‘সিটেই' যখন দেয়াল কিংবা সমান কাঁচের সংস্পর্শে আসে তখন দুইয়ের মধ্যে এক ধরণের সংযোগ স্থাপিত হয়; পদার্থবিদ্যার ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ভ্যান ডার ওয়ালস ইন্টারেকশন'৷ মিলিয়ন মিলিয়ন তন্তুর শক্তিই প্রাণীটিকে সমান দেয়াল থেকে আলাদা করতে বাধা দেয়, ফলে সে পড়ে যায় না৷ বিজ্ঞানী স্টানিস্লাভ গর্ব তাঁদের গবেষণার ব্যাপারে বলেন, ‘‘পর্যবেক্ষণ, এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা আমরা ইদানিং ভুলে যাচ্ছি৷ হ্যাঁ, অবশ্যই পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে, তবে তার আগে প্রকৃতির কাছে যেতে হবে এবং গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে যে প্রাণীরা কীভাবে নড়াচড়া করছে৷ আমরা জীববিজ্ঞানের এই পরীক্ষায় পদার্থ বিজ্ঞানের অনেক পদ্ধতি ব্যবহার করছি৷ জীব বিজ্ঞানে এভাবে প্রযুক্তিকে টেনে নিয়ে আসার বিষয়টি বেশ চমৎকার৷''
জীব বিজ্ঞান ও পদার্থ বিজ্ঞানের সমন্বয়
টিকিটিকি ও পোকার পায়ের গঠন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে দেখতে পেয়েছেন কীভাবে জীব বিজ্ঞান এবং পদার্থ বিজ্ঞান এক সূত্রে গেঁথে গেছে৷ এই সূত্র অনুসরণ করে বিজ্ঞানী স্টানিস্লাভ গর্ব ও তাঁর দল এক নতুন ধরণের টেপ আবিষ্কার করেছেন যার নাম দেওয়া হয়েছে গেকো টেপ৷ এই নতুন টেপ কাচের ওপর শক্ত হয়ে আটকে থাকতে পারে এমনকি বেশ ওজনও সইতে পারে৷ টেপটি সরিয়ে নেওয়ার পর কাচের ওপর আর কোন ছাপ থাকে না, অনেকটা টিকটিকি কিংবা পোকা মাকড় যেমন কোন ছাপ না রেখেই দেয়াল এবং কাচের ওপর চলাফেরা করে৷
বিজ্ঞানী গর্ব এর নতুন এই টেপ নিয়ে কাজ করছে জার্মানির ইলমেনাউ শহরের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি৷ তারা একটি ছোট্ট রোবটে এই টেপ ব্যবহার করেছে এবং সেটি ঢালু কাচের ওপর চলাফেরা করছে৷ সেখানকার গবেষক হারমুট ভিটে বললেন, ‘‘ রোবটের পায়ের সাদা জিনিসটি হচ্ছে গেকো টেপ৷ এটি পুরোপুরি টিকটিকির পায়ের মত নয়৷ কিন্তু তার মানে এই নয় যে এটিকে চামড়ার এবং সবুজ রং-এর হতে হবে৷ এটাতে কেবল কিছু সূত্র অনুসরণ করা হয়েছে৷''
বিজ্ঞানীরা আপাতত এই টেপকে রোবটের পায়ে পরাতে চাচ্ছেন যাতে করে বাড়ির ছাদে থাকা সোলার প্যানেল পরিষ্কার করার জন্য রোবটকে ব্যবহার করা যায়৷ এছাড়া একইভাবে বড় বড় ভবনের বাইরের দেয়াল পরিষ্কার করার বিষয়টিও তাদের মাথাতে রয়েছে৷ তবে সবচেয়ে বড় বিস্ময় হবে যদি এই টেপ মানুষের জুতোয় পরানো সম্ভব হয়৷ হয়তো ভবিষ্যতে দেখা যাবে, সিনেমার পর্দায় ‘স্পাইডারম্যান' নয়, জলজ্ব্যান্ত মানুষই ঘরের দেয়াল বেয়ে হেটে বেড়াচ্ছে!
তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, আপাতত সেই পর্যায়ে যাওয়ার কথা তারা ভাবছেন না৷
প্রতিবেদন: রিয়াজুল ইসলাম
সম্পাদনা: আবদুল্লাহ আল-ফারূক