1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

টিপ ইস্যু ও ঘুড়ি-উড়ানো সাংবাদিকতা

৮ এপ্রিল ২০২২

চলতি মাসে একজন পুলিশ কনস্টেবল ঢাকার একটি কলেজের শিক্ষিকার টিপ পরা নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের পর সামাজিক মাধ্যমের ম্যাজিক বুলেট বা ভাইরাল চাপে পড়ে মূল ধারার গণমাধ্যমগুলো ঘটনাটির ব্যাপক কভারেজ করেছে৷

https://p.dw.com/p/49e4z
টিপ ইস্যুর মূলে আছে ইভটিজিং ও নারীকে হেনস্তা করা৷
টিপ ইস্যুর মূলে আছে ইভটিজিং ও নারীকে হেনস্তা করা৷ছবি: AFP/Getty Images

বাংলাদেশে এ নিয়ে কয়েক বছরের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে একই কায়দায় প্রতিবাদের ঘটনা তৃতীয় বারের মতো ঘটলো৷ প্রথমবার ঘটেছিল ২০১৬ সালে৷ সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের নির্দেশনায় নারায়ণগঞ্জের একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তকে কান ধরে উঠ-বস করানোর প্রতিবাদে সামাজিক মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে অনেকেই কান ধরা ছবি পোস্ট করেছিলেন৷ দ্বিতীয়বার ঘটেছিল ২০২০ সালের অক্টোবরে৷ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারী নির্যাতন, সিলেটের এমসি কলেজে গণধর্ষণ ও খাগড়াছড়িতে প্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণসহ সমস্ত ধর্ষণ-নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে ‘ওমেন ব্ল্যাকআউট' বা কালো প্রতীকের প্রোফাইল ছবি সম্বলিত প্রতিবাদ হয়েছিল৷ সবশেষ আমরা দেখলাম চলতি মাসে এক পুলিশ কনস্টেবল ঢাকার একটি কলেজের শিক্ষিকার টিপপরা নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করা ও তাকে হেনস্তা করার পর কয়েকদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই টিপ পরা ছবি প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷ সঙ্গে আরেকটি বিষয় ঘটেছে, সেটি হলো সামাজিক মাধ্যমের ম্যাজিক বুলেট বা ভাইরাল চাপে পড়ে মূল ধারার গণমাধ্যমগুলো ঘটনাটির ব্যাপক কভারেজ করেছে৷ গণমাধ্যমের অতি উৎসাহী কভারেজে একদিকে নৈতিকতার ব্যতয় ঘটেছে অন্যদিকেগণমাধ্যম নিজের অজান্তেই সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় গোঁড়ামি ইত্যাদি ইস্যুতে উসকানি দিয়েছে৷ 

মানুষকে সংহত করতে সামাজিক মাধ্যমের ক্ষমতা এখন আর উড়িয়ে দেয়া যায় না৷ জি-২০ বিক্ষোভ থেকে আরব বসন্ত, ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ থেকে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ পর্যন্ত সব আন্দোলেন ও প্রতিবাদে বিশ্বব্যাপী জনসমর্থন আকৃষ্ট করতে সামাজিক মাধ্যম একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম৷ এ মাধ্যমের ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতির একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো অনিয়ম ও অবিচারের প্রমাণগুলো তুলে ধরে এত দ্রুত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া যায় ফলে দোষীদের সমাজের চোখে তুলে ধরা যায়৷ গবেষকরা মনে করেন, ১৯৬০'র দশকে সিভিল রাইটস মুভমেন্টের সময় সম্প্রচারমাধ্যম যে ভূমিকা পালন করেছিল ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার আন্দোলনের সময় সামাজিক মাধ্যম একই ভূমিকা পালন করেছিল৷ ‘ব্লাডি সানডে' ইমেজ যে উত্তাপ ১৯৬৫ সালে ছড়িয়েছিল একই ইন্ধন জুগিয়েছিল ডার্নেলা ফ্রেজিয়ারের ধারণ করা জর্জ ফ্লয়েডের ভিডিও ৷ বাংলাদেশে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে শুরু করে সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনে সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব আমরা দেখেছি৷

কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের এই আগুনের ছোঁয়ার বিপদও আছে৷ এই বিপদ দ্বিমুখী৷বিষয়টি দুই দিকে ধারালো তলোয়ারের মতো ক্ষমতাধর৷ এর মাধ্যমে ভুল তথ্য দ্রুত সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে যা বিভাজন আর বিদ্বেষের আগুনে ইন্ধন জোগায়৷ আরব বসন্ত থেকে শুরু করে ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস’-এর ওপর পরিচালিত কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক মাধ্যমে সংগঠিত প্রতিবাদ বা বিক্ষোভের সাফল্যের পর এই প্ল্যাটফর্মগুলো ভুল তথ্যের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ এ কারণে মিশরীয় বিপ্লবী ঘোনমিন তার এক নিবন্ধে বলেছেন, ‍'একই হাতিয়ার যা আমাদেরকে স্বৈরাচারী শাসকদের উৎখাত করতে ঐক্যবদ্ধ করে, শেষ পর্যন্ত তা আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়'৷

সামাজিক মাধ্যমে একই কায়দায় যেসব প্রতিবাদ হয়েছে সেগুলোতে চারটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাই৷ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সামাজিক মাধ্যমের প্রতিবাদগুলোর মতো এই বৈশিষ্ট্যগুলো বাংলাদেশের ঘটনাগুলোতে দেখা যায়৷ প্রথমত, সামাজিক মাধ্যমে কোন তথ্য বা ঘটনা তখনই সবচেয়ে বেশি গতি পায় যখন এটি একই সম্প্রদায়, বর্ণ, ধর্ম বা গোত্র কিংবা মানসিকতার কোনো স্বল্প পরিচিত বা অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে আসে৷ গবেষণায় দেখা গেছে, বন্ধু, পরিবারিক সদস্য বা প্রিয়জনের কাছ থেকে আসা তথ্য এতটা গতি সঞ্চার করতে পারে না৷ ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক কেলসি ক্রেশেমারের মতো এই বিষয়টি হলো ‘স্ট্রেনথ্ অব উইক টাইস' বা ‘দুর্বল সম্পর্কের শক্তি'৷ সামাজিক মাধ্যম রাগ এবং ভয়ের মতো কিছু মৌলিক মানবীয় আবেগকে সঞ্চারিত করে৷ এখানে অবিচার ও মানুষের দুর্ভোগের গল্পগুলো ব্যক্তিগত ফ্রেমে উঠে আসে, যার সঙ্গে যোগ হয় শক্তিশালী ছবি ও বার্তা৷ ব্যবহারকারীরা তাদের নেটওয়ার্কে সেগুলো শেয়ার করার সাথে সাথে এই গল্পগুলো ভাইরাল হয়ে যায়৷ দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো মিথ্যা ও ভুয়া তথ্যের ছড়াছড়ি৷ মিথ্যা তথ্য ও গুজব একটি সামাজিক আন্দোলনকে কীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে সেটি আমরা বাংলাদেশের সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় দেখেছি৷ সবশেষ টিপ ইস্যুতে দেখা গেছে, অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবলের মোটর সাইকেলের পেছনে তার গর্ভবর্তী স্ত্রী ছিল এমন মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্য দিয়ে কিভাবে অভিযোগকারীকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় তার চেষ্টা করা হয়েছে৷ তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিবাদ ও প্রতিবাদের বিষয়বস্তু নিয়ে দুটি গ্রুপের অবস্থান৷ সবশেষ বৈশিষ্ট্যটি হলো এই বিবাদমান দু'গ্রুপের আলোচনায় অনাবশ্যকভাবে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, রাজনৈতিক এবং জাতিগত ইস্যু টেনে নিয়ে এসে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ করা৷

শুরুতে সামাজিক মাধ্যমে একই রকম প্রতিবাদের ঘটনা হিসেবে বাংলাদেশের যে তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছি তার প্রত্যেকটিতে ধর্ম ও রাজনীতি কিংবা লিঙ্গ ও ধর্মের লড়াই ছিল৷ যার ফলশ্রুতিতে প্রতিবারই সামাজিক গণমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ঘটেছে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের উপর৷ অথচ সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের সূচনা হয় ব্যক্তি স্বাধীনতার ইস্যুতে৷ প্রতিবারই প্রতিবাদকারী ও বিরোধী উভয় গ্রুপের অনেকেই ধান ভানতে শিবের গীতের মতই ধর্ম, জাতিগত এবং রাজনৈতিক ইস্যুকে টেনে নিয়ে আসে যাতে ব্যক্তি স্বাধীনতার ইস্যুটি চরম ধর্ম সংকটের বিষয়ে আবর্তিত হয়ে 'নবমীর পাঁঠাতে' পরিণত হয়৷ অথচ মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করতে পারে বলেই সামাজিক মাধ্যমকে "স্বাধীনতা প্রযুক্তি বা লিবারেশন টেকনোলজি” হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷

২ এপ্রিল ঘটনাটির পর খুব বেশি গণমাধ্যমে এই খবর দেখা যায়নি৷ ফেসবুকে বিষয়টি ভাইরাল হলে পরদিন কয়েকটি গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়৷ তারপর সংসদ থেকে শুরু করে ঢাকার মাঠ আর ভার্চুয়াল জগত সরগরম হয়ে উঠলে গণমাধ্যমে ফলাও করে ঘটনাটি প্রচার ও প্রকাশ হয়েছে৷ সব রকমের বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে একটি কথা বলা যায়, রাজধানী ঢাকায় ঘটনা ও খবরের আধিক্য, পত্রিকা বা টেলিভিশনে জায়গা ও সময়ের দুষ্প্রাপ্যতা এবং সংবাদ মূল্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখা উপাদানগুলো বিচার করলে এই ঘটনাটি স্বাভাবিকভাবে জাতীয় দৈনিকে বা টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে স্থান পাওয়ার কথা নয়৷ সে দিক থেকে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ইস্যু এখন প্রায়ই সংবাদ মূল্য নির্ধারণে বড় নির্ণায়ক হয়ে ওঠছে৷ কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর জাতীয় দৈনিক, টেলিভিশন ও অনলাইনে যেভাবে একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যম থেকেই রসদ সংগ্রহ করে নানাভাবে খবর পরিবেশন করা হচ্ছে সেখানে মূলধারার গণমাধ্যমের সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র আর থাকছে না৷ 

সামাজিক মাধ্যম এবং গণমাধ্যমের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য হলো গণমাধ্যমে সম্পাদনার পর তথ্য পরিবেশিত হয়৷ অর্থাৎ যাচাই-বাছাই ও মূল্যায়নের মাধ্যমে নির্দিষ্ট গুরুত্ব দিয়ে তথ্য প্রচারিত বা প্রকাশিত হয়৷ সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও দায়িত্ববোধের প্রসঙ্গ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ টিপ ইস্যুতে সামাজিক মাধ্যমে যে যা মত প্রকাশ করেছে তাই কয়েকটি পত্রিকা, টেলিভিশন ও অনলাইন হুবহু প্রচার করেছে৷ কোনো ধরনের সম্পাদনা ছিল না, ছিল না কোনো ধরনের বাছ-বিচার৷ এটি কোন ধরনের দায়িত্ববোধসম্পন্ন গণমাধ্যম?

বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো যে কোনো ধরনের সম্পাদকীয় নীতি ছাড়া চলে এটি তার প্রমাণ৷ আবার টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অভিযোগকারীর ছবি ব্লার করে দিয়ে তার নাম, পরিচয় সবই প্রচার করেছে৷ পৃথিবীতে এমন অদ্ভুত নীতিমালা বাংলাদেশের গণমাধ্যমেই সম্ভব৷ উদ্ভট উঠের পিঠে চলছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম৷ এর আগে মুনিয়া আত্মহত্যার ঘটনায় একটি টিভি চ্যানেল ভিকটিমের ছবি ব্লার না করে অভিযুক্তের ছবি ব্লার করে খবর প্রচার করেছিল৷   

বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো কোনো ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা হিসেবে প্রায়ই দেখে৷ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্যার মূলে আঘাত করে না৷ সমস্যার কেন্দ্রে থাকা নিয়ামকগুলোকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় না৷ বরাবরের মত টিপ ইস্যুটিকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর কাছে একটি ভাইরাল হওয়া ইস্যু বা ঘটনা৷ সে কারণে সামাজিক মাধ্যমে এই ইস্যুতে নিয়ে ধর্মকে আঘাত করা, পুরুষতন্ত্র, রাজনীতিসহ নানা বিষয় জড়িয়ে যে যা পোস্ট করেছে গণমাধ্যমগুলো তাই প্রকাশ করেছে৷ একজন নারী টিপ পরবেন, কীভাবে পরবেন–এটা তার ব্যক্তি স্বাধীনতা৷ এর সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক, সংস্কৃতির সম্পর্ক নিয়ে লম্বা লম্বা কলাম আর সাক্ষাৎকার প্রকাশের আড়ালে গণমাধ্যমে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথাটাই অনুচ্চারিত থেকে গেলো৷ বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যক্তি, পরিবার, রাষ্ট্র এমনকি নিজ প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরেও ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে বড় ইস্যু করে দেখতে চায় না৷ সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে কখনই গণমাধ্যমগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি৷

টিপ ইস্যুর মূলে রয়েছে ইভটিজিং ও নারীকে হেনস্তা করা৷ ইভটিজিং কখনই আমাদের গণমাধ্যমের মুখ্য ইস্যু হয়ে উঠতে পারেনি৷ আর নারী  গণমাধ্যমের কাছে এখনও এনজিও সম্পর্কিত বিষয়৷ ২০১০ সালে উচ্চ আদালত ইভটিজিং প্রতিরোধে নীতিমালা তৈরির কথা বলেছিল৷ কিন্তু আজ পর্যন্ত যে সে নীতিমালা হয়নি সে বিষয়টি নিয়ে কয়টি পত্রিকা, ইস্যু তৈরি করে লাগাতার খবর পরিবেশন করেছে, কয়টি টিভি টক-শো করেছে? আদালতের ওই নির্দেশনায় ইভটিজিং প্রতিরোধে গণমাধ্যমের ভূমিকা কি হওয়া উচিত তাও বলা হয়েছিল৷ আজ পর্যন্ত কোনো গণমাধ্যম সে ভূমিকার কথা প্রচার বা প্রকাশ করেনি৷

মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষক
মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষকছবি: bdnews24.com

শুধু এই একটি ঘটনা নয়, সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া প্রায় প্রত্যেকটি ঘটনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সাধারণ যে চিত্র প্রকাশ পায় সেটি হলো, বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমই ঘটনার গভীরে যায় না৷ এখানে হাওয়ায় গা ভাসিয়ে চমক সৃষ্টির একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিযোগিতা থাকে৷ কুমিল্লার মন্দিরে হামলা, মুনিয়ার আত্মহত্যাসহ সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া অনেক ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম তাদের পাতায় বা স্ক্রিনে ততদিনই বিষয়টিকে জীবন্ত রেখেছিল যতদিন ফেসবুকে ইস্যুগুলো ভাসছিল৷ এসব ঘটনায় যথেষ্ট গুরুতর অভিযোগ ছিল৷ কিন্তু এসব অভিযোগের ব্যাপারে গণমাধ্যমে সে অর্থে কোনো ধরনের অনুসন্ধানী বা ফলো-আপ রিপোর্ট আমরা দেখিনি৷ 

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর এখনকার নীতি হলো যা ভাইরাল তাই সংবাদ আর যা খাওয়াবো তাই খাবে পাঠক-দর্শক৷ ভাইরাল ইস্যু নির্ভর এমন সাংবাদিকতাকে সাম্প্রতিক সময়ে বলা হচ্ছে ‘কাইট-ফ্লায়িং জার্নালিজম' বা ‘ঘুড়ি-উড়ানো সাংবাদিকতা'৷ এ ধরনের সাংবাদিকতায় তথ্যের গ্রহণযোগ্য উৎসের প্রয়োজন হয় না, গণমাধ্যমের সামাজিক দায়িত্ববোধের দরকার পড়ে না৷ ভারতীয় সাংবাদিক সত্য হিন্দির সম্পাদক আশুতোষ বলেছেন, ”আজকাল রিপোর্টাররা ঘুড়ি ওড়াতে ভালবাসেন, তাদের কারো কাছেই কোনো তথ্য নেই৷ কিন্তু খুবই আত্মবিশ্বাসী, তবে এটি নতুন সাংবাদিকতা যেখানে কোনো তথ্য নেই, কোনো যাচাই-বাছাই নেই৷” কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার অধ্যাপক স্টিফেন কুশন তাঁর এক নিবন্ধে কভিডকালে এ ধরনের সাংবাদিকতার চর্চা বেড়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের আস্থাহীনতার সংকট বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন৷ এই ঘুড়ি-উড়ানো সাংবাদিকতার লক্ষণ বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে৷ ফলে বাংলোদেশের সাংবাদিকতা চমক সৃষ্টিতে যতটা এগিয়ে যাচ্ছে–দায়িত্ববোধ, বস্তুনিষ্ঠতা ও সততার বিচারে ততটাই পিছিয়ে পড়ছে৷