টেকনাফে মানবপাচারের আস্তানা
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০উদ্ধার হওয়া তিনজনের সাথে কথা হয়েছে ডয়চে ভেলের৷ উদ্ধার করে তাদের প্রথমে সেন্টমার্টিন দ্বীপে রাখা হয়৷ তারা জানিয়েছেন তাদের সবাইকে মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে ওই পাহাড়ে এনে জড়ো করা হয় কয়েকদিন ধরে৷ মঙ্গলবার সকালে টেকনাফের নোয়াখালি ঘাট থেকে তাদের ছোট ছোট নৌকায় করে গভীর সমুদ্রে আরেকটি বড় ট্রলারে তোলা হয়৷ শাহপরী দ্বীপ ও ছেড়া দ্বীপের দক্ষিণে পাথরের সাথে ধাক্কা লেগে ওই ট্রলার ডুবে যায়৷ তবে অভিযোগ আছে পাচারকারীরা ইচ্ছে করে ট্রলারটি পাথরের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে ডুবিয়ে দেয়৷
টেকনাফ কোস্টগার্ড স্টেশন কমান্ডার লে. কমান্ডার সোহেল রানা ডয়চে ভেলেকে জানান,‘‘আমাদের প্রাথমিক হিসেবে ১৩৮ জন ছিল ওই বোটে৷ তাদের মধ্যে তিনটি শিশু ও ১২ জন নারীর মরদেহ এবং ৭২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে৷ বাকিরা নিখোঁজ৷ নিখোঁজদের মধ্যে সাত আট জন পলাতক আছে৷ তারা দালাল চক্রের সদস্য৷ তারা আগেই বোট থেকে লাফ দিয়ে পড়ে৷''
উদ্ধার হওয়ার রোহিঙ্গাদের একজন দিল বাহার থাকতেন উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে৷ দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে দিল বাহার ট্রলারে উঠেছিলেন সকাল সাতটার দিকে৷ তাদের প্রত্যেকের জন্য দালালের সঙ্গে ৪০ হাজার টাকা দেওয়ার চুক্তি হয়৷ দিল বাহার তিন হাজার করে টাকা দিয়েছিলেন৷ বাকি টাকা মালয়েশিয়া পৌছার পর শোধ করার কথা ছিলো৷ ট্রলার ডুবে যাওয়ার পর দিল বাহার তার এক মেয়েকে নিয়ে বেঁচে ফিরলেও তিন ছেলে মেয়ে নিখোঁজ রয়েছে৷ দিলবাহার বলেন ‘‘ছয়দিন আগে আমাদের ক্যাম্প থেকে এনে পাহাড়ে রাখা হয়৷ আরো অনেককে পাহাড়ে আনা হয়৷ আমার স্বামী আগেই মালয়েশিয়া গেছেন৷ এবার আমি আমার দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলাম৷''
১৪ বছর বয়সের রাজিমা আক্তারও মালয়েশিয়া যেতে চেয়েছিল৷ সে জানায় ‘‘টেকনাফের বিভিন্ন এলকা থেকে দালালেরা আমাদের সাতজনকে বিভিন্ন এলাকা থেকে তুলে পাঁচ দিন আগে পাহাড়ে নিয়ে যায়৷ আরো যারা ছিলেন তাদের কাউকে আগে আনা হয়৷ কাউকে আমাদের পরে আনা হয়৷ পাহাড়ে আমরা ১২০ জন নারী ও পুরুষ এবং ১৮ জন শিশু ছিলাম৷''
সে জানায়,‘‘২০-৩০ জন করে প্রথমে ছোট নৌকায় তোলা হয়৷ এরপর সবাইকে একটি বড় বোটে তোলা হয়৷ বড় বোটটি পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে ফেটে যায়৷ পানি উঠে ডুবে যায়৷ আমি সেখানে আরেকটি নৌকা পেয়ে সেটা ধরে ধরে তীরে আসি৷''
আবুল কালাম থাকেন টেকনাফ এলাকার একটি ক্যাম্পে থাকেন৷ তিনি জানান,‘‘সাইফুল নামে এক দালালকে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য৷ আমরা পরিচিত সাতজন একসঙ্গে ছিলাম৷ আমাদের বড় তিন তলা জাহাজে করে নেয়ার কথা ছিলো৷ রওয়ানা দেয়ার কয়েকদিন আগে আমাদের ক্যাম্প থেকে পাহাড়ে নিয়ে রাখা হয়৷ ইচ্ছে করে ট্রলারটি পাথরের সঙ্গে থাক্কা লাগিয়ে ডুবিয়ে দেয়া হয়৷''
সেন্টমার্টিন কোস্টগার্ড স্টেশন কমান্ডার নাঈমুল হক জানান,‘‘পাচারকারীরা এর আগেও ওই পাহাড়ে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে রোহঙ্গাদের এনে পরে পাচার করেছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে৷ আর আরো অনেককে পাহাড়ে রাখা হয়েছে পাচারের জন্য৷ ওই পাহাড়ে তাদের রাখার জন্য ছোট ছোট আধাপাকা ঘর আছে৷''
টেকনাফ কোস্টগার্ড স্টেশন কমান্ডার সোহেল রানা জানান,‘‘সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে ওই পাহাড়ের কথা জানিয়েছি৷ যতদূর খবর পেয়েছি পাচারকারীর ট্রলার ডুবির খবর পেয়ে পালিয়েছে৷ আর পাচারের উদ্দেশ্যে আরো যাদের জড়ো করা হয়েছিল তাদের দ্রুত যার যার ক্যাম্পে পঠিয়ে দিয়েছে৷''
তিনি জানান,‘‘ওই পাহাড়টি টেকনাফের নোয়াখালী পাড়ার কাছে৷ নোয়াখালী পাহাড় নামে পরিচিত৷
এদিকে উদ্ধার করা মরদেহগুলো ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে৷ আর যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদেরও সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফ থানায় আনা হচ্ছে৷
( যে তিনজন রোহিঙ্গা শরানার্থীর সঙ্গে কথা হয় তারা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলেন৷ কথা বুঝতে স্থানীয় অনুবাদক সাংবাদিক আব্দুর রহমানের সহায়তা নেয়া হয়৷ যারা অডিও শুনবেন তাদের সুবিধার জন্য অনুবাদকের বাংলা অডিওসহ দেয়া হয়েছে)