ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল সংসদে পাস
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮গত ২৯ জানুয়ারি‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮'এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়মন্ত্রিসভা৷ এরপর গত ৯ এপ্রিল এই আইনের খসড়া সংসদে উত্থাপন করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার৷ ওইদিনই বিলটি আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়৷ ১৭ সেপ্টেম্বর সংদীয় কমিটি সংসদে প্রতিবেদন জমা দেয়৷ বুধবার এটি সংসদে বিলটি পাশ হয়েছে৷
আইনটি নিয়ে শুরু থেকেই সাংবাদিকদের আপত্তি ছিল৷ সম্পাদকরা আনুষ্ঠানিকভাবেই বেশকিছু ধারার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন৷ এরপর সংসদীয় কমিটি সম্পাদক এবং সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে মতামত নেন৷ ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন'-এর সম্পাদক নঈম নিজাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা যেসব মতামত দিয়েছি সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে তার প্রতিফলন নেই৷ ব্রিটিশ আমলের অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টফিরিয়ে আনা হচ্ছে৷ এটা দুঃখজনক৷''
সংসদীয় কমিটিতে সম্পাদক পরিষদ প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ধারার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আপত্তি জানায়৷
প্রস্তাবিত আইনের ৮ ধারায় ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করলে ওই তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ক্ষেত্রমতে ব্লক করার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি অনুরোধ করতে পারবে৷
আরো বলা হয়েছে, যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে মনে হয় যে,ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য দেশের বা দেশের কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুন্ন করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহলে বাহিনী ওই তথ্য-উপাত্ত অপসারণ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মাধ্যমে বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে৷
এই ধারায় পরিবর্তনের জন্য সম্পাদক পরিষদ সংসদীয় কমিটিতে প্রস্তাব দিয়েছিল৷ তবে এখানে কোনো পরিবর্তন আনেনি কমিটি৷ সংসদীয় কমিটির সুপারিশে এই বিলে প্রয়োগ সংক্রান্ত বিধানে শর্ত যুক্ত করে বলা হয়েছে, ‘‘তবে শর্ত থাকে যে তথ্য অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ এর বিধানবলী কার্যকর থাকবে৷''
বিলের ১৮ ধারায় কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার সিস্টেমে বেআইনি প্রবেশে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড এবং তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল৷ সংসদীয় কমিটি এখানে শাস্তি কমিয়ে ছয় মাস কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখেছে৷
বিলের ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রচারণা বা প্রপাগান্ডার দণ্ডের বিধানের অংশে সংসদীয় কমিটি ‘জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা' যুক্ত করার সুপারিশ করেছে৷ এখানে শাস্তি কমানোরও সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি৷ বিলে ১৪ বছরের জেল বা এক কোটি টাকা কিংবা উভয়দণ্ডের বিধান ছিল৷ সংসদীয় কমিটি ১০ বছরের কারাদণ্ড করার সুপারিশ করেছে৷
২৫ ধারায় বলা ছিল, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছা করে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করে যা আক্রমণাত্মক, ভীতি প্রদর্শন বা কাউকে নীতিভ্রষ্ট করে বা বিরক্ত করে; অপমান, অপদস্থ বা হেয় করে; রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুন্ন করতে বা বিভ্রান্ত করতে কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত করে প্রকাশ বা প্রচার করে, তবে তা অপরাধ হবে৷
এই ধারার চারটি উপধারাকে ছোট করে দুটি উপধারা করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি৷ তবে মূল বক্তব্য প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে৷
২৮ ধারায় ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বিধানে শাস্তি কমানোর সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি৷ সংসদে উত্থাপিত বিলে সাত বছরের জেল বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল৷ সংসদীয় কমিটি কারাদণ্ড কমিয়ে ৫ বছর করার সুপারিশ করেছে৷
মানহানিকর তথ্য প্রচার নিয়ে ২৯ ধারায় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে আপত্তি করা হলেও সেখানে কোনো পরিবর্তন আনেনি সংসদীয় কমিটি৷ বিলে ৩১ ধারায় আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে এমন তথ্য প্রচারের বিষয়ে পরিবর্তন করার দাবি জানায় সম্পাদক পরিষদ৷ এক্ষেত্রেও সংসদীয় কমিটি কোনো পরিবর্তন আনেনি৷
সংসদে উত্থাপিত বিলের ৩২ ধারা নিয়ে সাংবাদিকদের সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল৷ ওই ধারায় সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যে-কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটি গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷
এখানে সংসদীয় সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘‘যদি কোনো ব্যক্তি ‘দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন-১৯২৩' এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত করে বা করতে সহায়তা করে, তাহলে তিনি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷''
সংসদে উত্থাপিত বিলে এই আইনের অধীনে পুলিশকে সংঘটিত অপরাধের জন্য বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল৷ সংসদীয় কমিটি এখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালকের অনুমোদনসাপেক্ষে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের বিধান রাখার সুপারিশ করেছে৷
নঈম নিজাম বলেন, ‘‘আমরা সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে প্রথমেই প্রস্তাবিত আইনটি প্রত্যাখ্যান করেছি৷ আমরা বলেছি, এখানে যদি সংশোধনী আনা না হয়, তাহলে গ্রহণযোগ্য হবে না৷ আমরা আইনমন্ত্রী, আইসিটি মন্ত্রী এবং তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আমাদের সংশোধনী প্রস্তাকগুলো দিয়েছি৷ সেই সংশোধনীগুলো গ্রহণ না করায় আমরা মনে করি আইনটি একটি কালাকানুন হিসেবে চিহ্নিত হবে৷ ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট ফিরিয়ে আনা কোনোভাবে সাংবাদিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না৷ আর মানুষের যে কথা বলার অধিকার, প্রতিবাদ করার অধিকার, এটাকে আইন দিয়ে বন্ধ করা যাবে না৷ এই আইনে অনেকগুলো ধারা আছে, যা সাংবাদিকদের ক্ষতি ডেকে আনবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মেইন স্ট্রিম মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যমকে আলাদাভাবে দেখা উচিত৷মেইন স্ট্রিম মিডিয়া গুজব ছড়ায় না৷ রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে ঘটানো হয়েছে৷ আর অনেকগুলো বিষয় আছে যা প্রচলিত আইনেই বিচার সম্ভব৷ নতুন আইনের দরকার নেই৷''
একুশে টেলিভিশনের চিফ এডিটর এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘সংসদীয় কমিটির সঙ্গে আমাদের চূড়ান্ত বৈঠক যেটা হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি, যার ফলে তাঁরা যেটা করেছেন, সেখানে চূড়ান্তভাবে আমাদের মতের প্রতিফলন হয়নি৷ আমরা সংসদীয় কমিটির সঙ্গে দু'টি এবং আইনমন্ত্রীর সঙ্গে একটি বৈঠক করেছি৷ কথা ছিল চূড়ান্ত করার আগে তাঁরা আবার আমাদের সঙ্গে বসবেন৷ কিন্তু আমাদের সঙ্গে না বসেই সংসদে নিয়ে গেছে৷ এর ফলে আমাদের কথার কিছু কিছু প্রতিফলন আছে৷ যেমন, আইনটির শিরোনাম পরিবর্তন করা হয়েছে৷ কয়েকটি জায়গায় শাস্তি কমানো হয়েছে৷ তবে সেটা আমাদের চাহিদামতো করা হয়নি৷ আমরা তথ্য অধিকার আইনটাকে আনার কথা বলেছিলাম৷ আইনটি আনা হয়েছে৷ কিন্তু ৩২ ধারা, যেটা নিয়ে সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় আপত্তি৷ সেখানে ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টটাকে এনেছে৷ তথ্য অধিকার আইন যখন তৈরি হয়, তখন বলা হয়েছে, অবাধ তথ্য প্রবাহের স্বার্থে তথ্য অধিকার আইন সবচেয়ে বড় হবে৷ অন্য কোনো আইন তাকে বাঁধা দিতে পারবে না৷ কিন্তু এখন তথ্য অধিকার আইনও আনা হলো, আবার অফিসিয়িাল সিক্রেটস আইনকে নিয়ে আসা হলো, যে আইনটি তথ্য অধিকার আইনের কারণে অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু তাকে নতুন করে গুরুত্ব দিয়ে ফিরিয়ে আনা হলো, যা তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থায় চলে গেল৷''
তিনি বলেন, ‘‘এটা সাংবাদিকদের জন্য হতাশাজনক৷ আমরা উদ্বিগ্ন এবং হতাশ৷ তবে আশা করি, তথ্য প্রযুক্তি আইনের অপপ্রয়োগ হবে না বলে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, এই আইনটিরও অপপ্রয়োগ যাতে না হয় সেদিকে সংসদ সদস্যরা নজর দেবেন৷ আমাদের উদ্বেগ বিবেচনায় নেবেন৷ এই আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে যদি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়, তাহলে তা বড় একটি হতাশার জায়গা হবে৷ কারণ, আমরা তথ্য অধিকার আইন এবং সম্প্রচার আইনের মাধ্যমে কিছু দূর এগিয়ে ছিলাম৷ কিন্তু আইনটি সাংবাদিকদের নতুন করে হতাশা ও আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিলো৷''