ডোকলাম নিয়ে সংঘাতের মেঘ কি কাটবে?
২৩ আগস্ট ২০১৭ডোকলাম নিয়ে ভারত ও চীনের স্নায়ুযুদ্ধ চরমে গেলেও মোদী সরকার কিন্তু হাল ছাড়েননি৷ কূটনৈতিক দৌত্য চালিয়ে যাচ্ছে৷ তাতে নাকি ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে৷ চীন-ভারত সীমান্ত অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর এক অনুষ্ঠানে একথা বলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং৷ বলেছেন, ডোকলাম সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব হবে৷ এ বছরের শেষ নাগাদ চীনের পার্টি কংগ্রেসে নতুন প্রেসিডেন্টের নির্বাচন৷ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলেই পরিস্থিতি থিতিয়ে আসবে৷ পাশাপাশি ডোকলামের ওপর দাবি বজায় রেখেও চীন এক বিবৃতিতে অনুরূপ আশা প্রকাশ করেছে৷ ভারত ও চীন বিশ্বের দু'টি প্রচীনতম সভ্যতার অন্যতম৷ পারস্পরিক সম্প্রীতি রক্ষা করা দরকার৷ তাতেই দু'টি দেশের ২৭০ কোটি মানুষের মঙ্গল৷ ডোকলাম সমস্যা সেভাবেই মেটাতে হবে৷ কেউ কারোর জন্মশত্রু হতে পারে না৷ উভয় দেশের বার্তাই ইতিবাচক৷ এর পেছনে দুই দেশের অর্থনৈতিক তথা বাণিজ্যিক স্বার্থ অস্বীকার করা যায় না৷ আগামী মাসে ব্রিকস সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদীর চীন যাবার কথা৷
ভারত, চীন ও ভুটানের ত্রিমুখী সীমান্তে ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে ডোকলাম মালভূমিতে বেইজিং সড়ক বানাতে চাইছে নিজের স্বার্থে৷ প্রতিবেশী দেশগুলির স্বার্থের তোয়াক্কা না করে৷ চীনের দাবি ঐ এলাকা চীনের৷ আসলে ভৌগোলিক দিক থেকে এলাকাটা ভুটানের৷ তাহলে ভারত সেখানে সেনা পাঠালো কেন? প্রথমত চীন যদি ঐ এলাকায় সড়ক বানায় তাহলে উত্তর-পূ্র্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে দেশের অবশিষ্ট অংশের যোগাযোগ বেইজিং দরকার হলে সহজেই বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবে৷ দিল্লির পক্ষে বাড়তি উদ্বেগের আরও একটা কারণ ভারত-চীন সংঘাতের সুযোগ নিয়ে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির জঙ্গি সংগঠনগুলি অস্থিরতা বাড়াতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন৷ সেক্ষেত্রে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থের বিপদ বাড়বে৷ দ্বিতীয়ত, ভারত-ভুটান দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী, ভুটানের নিরাপত্তায় সাহায্য করতে দিল্লি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ যুযুধান দুই প্রতিপক্ষের সেনা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে গত আড়াই মাস ধরে৷ উত্তাপ ক্রমশ বাড়ছিল৷ একতরফা সেনা সরাবার জন্য দিল্লির ওপর চাপ বাড়াতে বেইজিংয়ের রণহুঙ্কার উত্তরোত্তর তীব্র হচ্ছিল৷ তবুও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে কূটনৈতিক পথে চেষ্টা চালিয়ে যায় মোদী সরকার৷
এ বিষয়ে জাপানের ভূমিকায় মোদীর হাত আরও মজবুত হলো৷ নতুন দিল্লির জাপানি রাষ্ট্রদূত কেনজি হিরামাত্সু বলেছেন, বিতর্কিত এলাকার স্থিতাবস্থা বজায় রাখা জরুরি৷ এক তরফাভাবে সেখানকার ভূমিগত পরিস্থিতি পালটাতে পারেনা বেইজিং৷ স্বভাবতই ভারত জাপানের এই অবস্থানে খুশি৷ কিন্তু প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি পররাষ্ট্র বিভাগ৷ পাছে আপোষ প্রক্রিয়া আরো জটিল হয়৷ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র রভিশ কুমার বলেছেন, জাপানের বিবৃতিটির নিহিত অর্থ পরিষ্কার৷ নিজেই নিজের কথা বলেছে৷ তবে ডোকলাম নিয়ে শক্তিশালী দেশ জাপানের এই প্রথম মুখ খোলাটা বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন দিল্লির কূটনৈতিক মহল৷ তবে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে টোকিও কেন দাঁড়ালো দিল্লির পাশে? কূটনৈতিক মহলের মতে, প্রথমত, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ভারত সফরে আসছেন আগামী মাসে৷ দিল্লি-টোকিও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটা আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া৷ দ্বিতীয়ত, দিল্লির মতো বেইজিংয়ের সঙ্গে অনুরূপ সংঘাতের অভিজ্ঞতা টোকিওর হয়েছে৷ বিতর্কিত জাপানি সেনকাকু দ্বীপের কাছে চীনের মাছ ধরা ট্রলারের সঙ্গে জাপানের টহলদারি উপকূল রক্ষী বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের পর টোকিও-বেইজিং সম্পর্ক যথেষ্ট তিক্ত৷ এশিয়ায় চীনের অতি সক্রিয়তা এবং আধিপত্য কায়েম করার প্রবণতার প্রেক্ষিতে ভারত-জাপান সহযোগিতার সমন্বয় সমান জরুরি৷
চীনের মতিগতি বোঝা দায়৷ ‘হিন্দি-চীনি ভাই-ভাই' হবার পরও দলাই লামাকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে ১৯৬২ সালে যুদ্ধ৷ তাই ডোকলাম উত্তাপ যদি বাড়তে থাকে, কূটনৈতিক পথে সমাধান না হয়, যুদ্ধ যদি দুর্ভাগ্যক্রমে অনিবার্য হয়ে পড়ে, তাহলে সেই যুদ্ধে ভারত কি এঁটে উঠতে পারবে চীনের সঙ্গে? ডয়চে ভেলে এই প্রশ্নটা রেখেছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক অনিন্দ্য মজুমদারের কাছে৷ উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘সংঘর্ষ যদি বেঁধেই যায়, চীন যদি গায়ের জোরে সমাধানের চেষ্টা করে, তাহলে তার প্রত্যুত্তরে ভারত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তেই পারে৷ চীনের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে কিনা সেটা অন্য প্রশ্ন৷ সংখ্যার বিচারে চীনের সৈন্যবল বেশি, অস্ত্রশস্ত্র বেশি৷''
তবে ডয়চে ভেলেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিদ্যার অধ্যাপক অনিন্দ্য মজুমদার আরো বলেন, ‘‘কিন্তু আধুনিক যুদ্ধ সংখ্যার বিচারে হয় না৷ নির্ভর করে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বা নিজস্ব ধারার ওপর৷ আর অন্য বিকল্প হলো, ভারতকে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে৷ মেনে নিতে হবে চীনের দখলদারিকে৷ তবে একটা কথা, আজকালকার দিনে যুদ্ধ হয় একটা সীমিত এলাকায়৷ ব্যাপক ক্ষেত্রে নয়৷ কারণ, বিশ্বের অন্যসব দেশ চীনের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে৷ আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় নিজের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে চীনকে তা মেনে নিতে হবে৷ আরেকটা কথা, চীন মুখে বহুমেরু বিশ্বের কথা বলে থাকলেও আসলে এশিয়ায় একমেরু গড়ে তুলতে চায়৷ চীনের কার্যকলাপ দেখে মনে হয় না, বেইজিং গ্লোবাল ব্যালেন্সে আগ্রহী৷''