মেগাসিটিতে যানজট রোখার উপায়
২ মার্চ ২০১৬নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস বা টরন্টোকে মেগাসিটি বললে একটা ছবি ভেসে ওঠে, এক অর্থ দাঁড়ায় – আর তৃতীয় বিশ্বের মেগাসিটিগুলোর কথা বললে আরেক ছবি পাওয়া যায়, আরেক অর্থ দাঁড়ায়৷ দু'ধরনের মেগাসিটিতেই গাড়ি চলে, দেখলে মনে হবে, বড় বেশি গাড়ি – কিন্তু কথাটা কি সত্যি? ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় যেখানে প্রতি এক হাজার বাসিন্দার জন্য গড়ে তিনটি গাড়ি চলে, সেখানে শিল্পোন্নত বিশ্বের মেগাসিটিগুলোতে প্রতি হাজার বাসিন্দার জন্য গাড়ির সংখ্যা হলো ৭০০! সে হিসেবে ঢাকার রাস্তায় তো যানজট হওয়ারই কথা নয়৷
শিল্পোন্নত বিশ্বের মানদণ্ড দিয়ে উন্নয়নশীল বিশ্বকে মাপতে গেলেই গোলমালে পড়তে হবে৷ একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে৷ শিল্পোন্নত বিশ্বে মেগাসিটি যতো বাড়ে, তার সঙ্গে বাড়ে ও বদলায় তার অবকাঠামো – যেন ছেলে যত বাড়ছে, তার জন্য তত নতুন জামাকাপড় কেনা হচ্ছে৷ কিন্তু ঢাকার মতো শহরের অবকাঠামো আদিতে পরিকল্পনা করা হয়েছিল বড়জোর ২০ লাখ মানুষের জন্য – বিশেষ করে রাস্তা ও যানবাহনের ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য৷ এককালে শহর কলকাতায় রাস্তার পরিমাণ ছিল আয়তনের মোট ছয় শতাংশ – পরে গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে ২০০ গুণ! কিন্তু রাস্তা সেই পরিমাণে বেড়েছে বা চওড়া হয়েছে কি?
কেউ যেন মনে না করেন যে ঢাকা-কলকাতার কর্তৃপক্ষ হাত গুটিয়ে বসে আছেন৷ তারা নানা ধরনের সমাধান পরীক্ষা করে দেখছেন৷ কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির মতোই যানবাহন বাড়ছে যেন প্রাকৃতিক নিয়মে, প্রাকৃতিক হারে৷ কোনো ছোট পাখির বাসায় বড় পাখির ছানাকে খাইয়ে-দাইয়ে মানুষ করতে বেচারা বাবা পাখি আর মা পাখির যেমন নাভিশ্বাস ওঠে, এ যেন ঠিক সেই রকম৷ জওহরলাল নেহরু একবার এক পশ্চিমা সাংবাদিককে বলেছিলেন: ‘আমাদের প্রগতি হয় না কেন জানো? আমাদের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার জন্য খুব জোরে দৌড়তে হয়৷' যেন কোনো জিমের ট্রেডমিল – অর্থাৎ প্রগতি যা হচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি তা খেয়ে যাচ্ছে৷ ঢাকা-কলকাতার ট্র্যাফিক সামলাতে সরকার যাই করুন না কেন, ট্র্যাফিক বেড়ে তা দু'দিনের মধ্যে হজম করে বসে থাকে৷ ওদিকে ২০১৪-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকার যানজটে পণ্য ও পরিষেবা উৎপাদনের ক্ষতি হচ্ছে বছরে ৩৮৬ কোটি ডলার, যা কিনা বাংলাদেশের ২০১২ সালের জিডিপি-র ৩ দশমিক ৩ শতাংশ৷
নানা মুনির নানা মত
তাহলে কি কিছুই করার নেই? আছে বৈকি৷ কিন্তু তত্ত্ব এক ব্যাপার, আর সেই তত্ত্ব – এবং তথ্যের – ভিত্তিতে বাস্তব পরিকল্পনা করে, সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করা আরেক ব্যাপার – যে কাজের জন্য বিশেষজ্ঞ, কর্তৃপক্ষরা আছেন৷ আমরা যারা – প্রবাসী হলেও – ভুক্তভোগী, তারা শুধু সোচ্চার চিন্তা করতে পারেন: এটা করলে হয় না? ওটা করলে হয় না?
যেমন জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপি সরকারি পরিবহণ বৃদ্ধি ও সেই সঙ্গে গাড়ির বদলে সাইকেল চালানো বাড়ানোয় বিশ্বাসী৷ তারা চায় রাস্তায় বাস আর সাইকেলের জন্য আলাদা ‘লেন' করা হোক – ঢাকা-কলকাতার রাস্তায় সেটা কতটা সম্ভব, আপনারাই ভেবে নিন৷ অন্যদিকে ইউএনডিপি-কে জিগ্যেস করলে তারা বলবে, ট্র্যাফিক রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস – নিয়মকানুন – কড়াভাবে প্রয়োগ করো; অন্যদিকে গাড়িচালকদের বলো, উচ্ছৃঙ্খলের মতো গাড়ি না চালাতে৷
এভাবেই এসে পড়বে নানা পশ্চিমা সমাধান, যা পুবের মেগাসিটিতে গোঁত্তা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে৷ কখনো শুনবেন একজন ড্রাইভারের জন্য সরু গাড়ি তৈরি করা হচ্ছে, তার কথা৷ কখনো শুনবেন ‘কার পুলিং'-এর কথা৷ কেউ বলছেন, সিটির মাস্টার প্ল্যান কেঁটে গণ্ডূষ করতে হবে: বাস টার্মিনাল, মার্কেট, শপিং মল, রিক্রিয়েশন সেন্টার, এ সব ‘রি-লোকেট' করো – মাপ করবেন, আপনি কি আমাদের ঢাকা-কলকাতার কথাই বলছেন?
আবার শুনবেন, থ্রি-ই পদ্ধতিতে মুশকিল আসান: ইঞ্জিনিয়ারিং – চওড়া, একাধিক লেনের রাস্তা; বিআরটি বা বাস ব়্যাপিড ট্রানজিট; লাইট রেল থেকে মোনোরেল থেকে স্কাইট্রেন; অন্যদিকে এনফোর্সমেন্ট মানে ট্র্যাফিক পুলিশ; আর এডুকেশন মানে জনশিক্ষা৷ শুনবেন ‘টল' বসিয়ে শহরের কেন্দ্রে ট্র্যাফিক কমানোর কথা; স্মার্ট ট্র্যাফিক লাইটের কথা; এছাড়া বাড়ির কাছে অফিস, স্কুল-কাছারির টাইম বদলানো, শহর ঘিরে বাইপাস – সমাধানের কি কোনো কমতি আছে?
বাস করি চার লাখ মানুষের ইউনিভার্সিটি শহরে৷ এখানে গাড়ি চালাচ্ছি বেশ কয়েক দশক৷ বন শহরে এখন দু'টি সমাধানের ধুম চলেছে: (১) উষ্ণায়নের ফলে এই শীতেও মানুষজন সাইকেল চালিয়ে অফিস যাচ্ছেন; (২) গোলচক্কর, মানে ট্র্যাফিক রাউন্ড্যাবাউট৷ আমাদের প্লিটার্সডর্ফের পাঁচ মাথার মোড়ে এখন রাউন্ড্যাবাউট তৈরি হচ্ছে, যার ফলে শুধু ট্র্যফিক লাইট বাঁচবে পাঁচ-পাঁচটা৷
জার্মানিতেও যানজট হয় – শুধু অটোবান, মানে মোটরওয়েতেই নয়, শহরেও৷ তবে কম হয় আর হলেও তাড়াতাড়ি সামলে যায় – কেন জানেন? এখানকার লোক আইন মানে বলে৷ যা দেখে মনে হয়: যানজট সমস্যার সমাধান কি তাহলে – শৃঙ্খলা?
আপনি কি লেখকের সঙ্গে একমত? জানান আপনার মতামত, নীচের ঘরে৷