ঢাকায় ওয়াসার সব পানিতেই থাকছে ‘ই-কোলাই'
১৪ মে ২০১৯ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে সুপেয় পানির সার্বিক পরিস্থিতি কেমন? এ নিয়ে গবেষণা কী বলছে?
দিবালোক সিংহ: আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির পাশাপাশি নদী থেকে আমরা প্রচুর পানি পেয়ে থাকি প্রতি বছর৷ বর্ষার সময়ে এই পানি বেশি হয়ে যায়, আর শুকনা সময়ে কমে যায়৷ এমনিতে আমাদের পানির যে ব্যবহার, তাতে ৮৫ ভাগ পানি আমরা ব্যবহার করি, কৃষির জন্য৷ আর আমাদের গৃহস্থালির জন্য ১২ থেকে ১৩% ব্যবহার করি৷ আমাদের শিল্পের জন্য ২% ব্যবহার করি৷ এখানে যে সমস্যাটা বিরাজ করছে, সেটা দুই ধরনের৷ একটি হলো, আমাদের পানিতে রাসায়নিক দ্রব্যের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি, যেটা আমাদেরকে বহুদিন ধরে ভোগাচ্ছে, সেটা হলো আর্সেনিক৷ আর্সেনিক ছাড়া ম্যাঙ্গানিজ বা ফ্লোরাইডের আরো কিছু রাসায়নিক পদার্থ আমাদের এখানে বাড়ছে৷ বাংলাদেশের নিজস্ব যে স্ট্যান্ডার্ড আছে, সেটার তুলনায় এটা বেড়ে যাচ্ছে৷ এসব রাসায়নিকের লেভেলকে আমাদের নির্দিষ্ট মানের মধ্যে আনতে হবে৷ দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো, মল-বর্জ্য দ্বারা আমাদের পানির বিভিন্ন যেসব সূত্র আছে, সেগুলো সংক্রমিত হয়ে যাচ্ছে৷ এই দু'টি বিষয় আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে৷
২০১৩ সালের যে ডাটা আছে, তাতে আমাদের ৯৭% লোকের পানির অভিগম্যতা আছে৷ কিন্তু যখন আমরা আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজ, ফ্লোরাইড এবং মল-বর্জ্য দ্বারা দূষণের বিষয় বিবেচনায় নিচ্ছি, তখন আমাদের দেশের মানুষের নিরাপদ পানির অভিগম্যতা কমে দাঁড়াচ্ছে ৩৫ শতাংশে৷ এটা আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ৷
বাংলাদেশের সুপেয় পানির যেসব উৎস রয়েছে, সেটা কতটা পর্যাপ্ত? সেগুলোর দূষণ কী মাত্রায় হয়েছে?
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের যে পানি-সম্পদ আছে, সেটার ১ শতাংশ আমরা ব্যবহার করছি৷ কিন্তু এই ব্যবহার করতে যাওয়ার ফলে কিছু সমস্যা আমরা মোকাবেলা করছি৷ আমাদের মল-বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা যেহেতু প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, সেহেতু আমাদের বেশির ভাগ মল-বর্জ্য নালার মাধ্যমে খাল, সেখান থেকে নদ-নদী বা জলাশয়ে পরিশোধন করা ছাড়াই চলে যাচ্ছে৷ চলে যাওয়ার ফলে, এটা আমাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য এবং পরিবেশের ক্ষেত্রে ঝুঁকির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে৷ এটা আস্তে আস্তে ঘটছে৷ যার ফলে দেখবেন, আমাদের ঢাকার চারপাশের নদীগুলো পরিশোধনের অযোগ্য হয়ে পড়েছে৷ অনেক দিন ধরেই এটা হয়েছে৷ কিন্তু এটা তো মন্ত্রণালয়ের নাকের ডগায় ছিল একেবারে৷ সেটা নিয়ে খুব বেশি নড়াচড়া এখন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না৷ সেটা হলো, ঝুঁকির দিক৷ এই ঝুঁকি থেকে বাঁচতে হলে এই মলবর্জ্যগুলো পরিশোধন হয়ে যাতে আমাদের প্রকৃতিতে ফিরে আসে, সেজন্য পরিশোধন ব্যবস্থাটা জোরালো করতে হবে৷
আমাদের যে অভিজ্ঞতা, তাতে দেখা যায়, আশেপাশের জলাশয় যেগুলো আছে, সেগুলো আর পান করার পর্যায়ে থাকছে না৷ এটা দু'টো কারণে হচ্ছে, একটি হলো মল-বর্জ্য এবং বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে, যেগুলো আপনি পরিশোধনও করতে পারছেন না৷
ওয়াসা এখন কোন ধরণের প্রক্রিয়ায় পানি বিশুদ্ধ করছে? এ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন বা পরামর্শ কী?
ওয়াসার সঙ্গে আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি৷ উনাদের যে ট্রিটেমন্ট প্লান্ট, কেন্দ্রীয়ভাবে সেটা ক্লোরিনেশন করা হয়৷ কিন্তু এখানে সমস্যাটা যেটা অনেক দিন ধরে চলে আসছে, এটার পাইপ সিস্টেম যে নষ্ট বা ফুটা হয়ে গিয়ে থাকে, সেটার ভেতরে ময়লা পানি ঢুকে যাচ্ছে৷ ময়লা পানি বের হওয়ার সুযোগ না পাওয়ার কারণে, এটা সংক্রমিত হচ্ছে৷ সংক্রমিত হওয়ার ফলে সেটা ঢাকা শহরের মানুষ না ফুটিয়ে পান করছে না৷ এখানে একটা জিনিস আলাদা করার প্রসঙ্গ আছে, সেটা হলো- যাঁরা দরিদ্র লোক বা সাধারণভাবে নিম্নবিত্ত অবস্থায় আছেন, তাঁদের অপশন তো ছিল, তাঁরা আইনসঙ্গত পানি পাচ্ছেন না৷ ওয়াসার পানিতে ই-কোলাই আছে, সেটা গবেষণায়ও বেরিয়ে এসেছে৷ ঢাকা শহরের মানুষ সবাই সেটা জানে৷ নিরাপদ হওয়ার জন্য মানুষ ফুটিয়েই পান করছে৷
ওয়াসা যে পানিটা সরবরাহ করে, সেটা সাধারণভাবে ভূগর্ভস্থ পানি, ৭৮ শতাংশের মতো৷ বাকি ২২% তারা ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করে থাকে৷ ভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ পানি তারা ক্লোরিন দিয়ে পরিষ্কার করে, এটাই তাদের সিস্টেম৷
মানুষ যখন টেপ থেকে পানি নিয়ে যাচ্ছে, তখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সচেতনতা না থাকায় সেগুলো পুনরায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে৷
ঢাকা শহরের বাসিন্দারা কতটা সুপেয় পানি পাচ্ছে?
ঢাকা শহরে ওয়াসার পানি যেটা দিচ্ছে, সেটাতে ই-কোলাই থাকছে৷ সে কারণে নিরাপদ পানি বলতে যেটা, সেটা মানুষ পাচ্ছে না৷ পাইপ ওয়াটার হলেও এর মধ্যে ই-কোলাই আছে৷ পাইপের পানি সবসময়ই জীবাণুমুক্ত করতে হবে৷ জীবাণুমুক্ত করার জন্য ক্লোরিন দেওয়ার পাশাপাশি যেখান থেকে পানি আসছে, সেটাকেও জীবাণুমুক্ত করার প্রক্রিয়া রাখতে হবে৷
উন্নত বিশ্বে শিল্প, এমনকি মানব বর্জ্য মিশ্রিত পানিও পরিশোধনের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হচ্ছে৷ বাংলাদেশে আপনি নিজে এমন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন৷ আমাদের দেশে এমন উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ কী?
আমি এবং আমার মতো অনেকেই বাংলাদেশে এটার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করছি৷ আমাদের এখানে মল-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টিএখনো খুব জোরালো হয়নি৷ ঢাকা শহরে মাত্র একটা স্যুয়ারেজ প্লান্ট আছে৷ আরেকটির নির্মাণকাজ এখনো চলছে৷ আরো ৩-৪টা করা হবে৷ ঢাকা শহরে ধরুন, দুই কোটি লোক থাকে, এর বাইরে যারা আছে তাদের জন্য তো কোনো স্যুয়ারেজ সিস্টেম নেই৷ এবং তাদের জন্য কোনো মল-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও নাই৷ সেখানে আমরা সেপটিক ট্যাঙ্ক বা কুয়া পায়খানা ব্যবহার করছি৷ সেগুলো ব্যবহারের পর যেখানে-সেখানে ফেলে দেওয়ার ফলে আশেপাশের জলাশয় বা নদী-নালাগুলোতে চলে যাচ্ছে৷ এরপর প্রকৃতিতে চলে যায়৷ মল-বর্জ্য যাতে কোনোভাবে প্রকৃতিতে যেতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে৷
ভিয়েতনামের উদাহরণ যদি আমি দিই, সেখানে মল-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চমৎকার একটা সিস্টেম আছে৷ কোন গতিতে সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার হবে সেটা নির্দিষ্ট এবং এটা পরিষ্কারের জন্য কর দিতে হয়৷ ট্যাঙ্ক পূর্ণ হলে সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার গাড়ি এসে সেটা পরিশোধনাগারে নিয়ে যায়৷ পরিশোধনের পর বর্জ্য সার বানানোর কাজে লাগে এবং যেটুকু পানি থাকবে, সেটা প্রকৃতিতে ফেরত পাঠানোর জন্য নিরাপদ৷
বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে একটা নীতিমালা গ্রহণ করেছে৷ এখন এই নীতিমালাটাকে বাস্তবায়নের জন্য পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে৷ নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়ন করতে হবে৷ বিদেশে এটা করার ক্ষেত্রে অর্থ খরচ করে, কারিগরি পদক্ষেপ আছে, সব ব্যবস্থা নিতে হবে৷
রাজধানীতে যাঁরা আছেন তাঁদের একটি বড় অংশ বস্তিতে বসবাস করছেন৷ এ মানুষগুলোর সুপেয় পানি প্রাপ্তির ব্যবস্থা কেমন?
ঢাকা শহরে ওয়াসা ছাড়া কোনো পানি নেই৷ যদিও এদিক-সেদিক কিছু থেকেও থাকে, সেগুলো থেকে পানি সাধারণত আসে না৷ ঢাকা শহরে যেসব বড় বড় ডিপটিউবয়েলগুলো আছে, সেগুলো কেন্দ্রে৷ কিন্তু আমাদের বস্তিগুলো নানাপ্রান্তে৷ তাঁরা যেহেতু প্রান্তস্থিত এলাকায় বসবাস করেন, সেখানে ওয়াসার পাইপের প্রেসার সেভাবে যায় না৷ পানি সরবরাহ সেভাবে পাচ্ছেন না৷ একজন লোককে মিনিমাম ২৫ লিটার পানি প্রতিদিন পেতে হবে৷ তাহলে সে প্রাত্যহিক সমস্ত কাজ মোটামুটিভাবে সমাপ্ত করতে পারবে৷
ঢাকা শহরের অনেক বস্তিবাসী ওয়াসার পানি প্রাপ্তিতে নিবন্ধিত হওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে৷ তারা যেহেতু প্রান্তস্থিত এলাকায় থাকে, তাতে পানি তারা পায় না৷ ওয়াসা বলে থাকে, তারা চাহিদার চেয়ে বেশি পানি উৎপাদন করছে, কিন্তু সেটার বন্টন সব জায়গায় সমান না৷ কিন্তু কোনো প্রান্তে উদ্বৃত্ত পানি থাকলেও কারগরি সক্ষমতার কারণে পানি সে প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে নিতে পারে না৷
আইনগতভাবে ঢাকা শহরের বস্তিবাসীরা পানি পাবেন, এটা তাঁদের ওয়াসা অনেক আগে স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে এবং সে অনুযায়ী কাজ চলছে৷ এটা একটা ভালো দিক৷ এবং ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা বস্তিবাসীদের পানি দিতে চান এবং এর কাজ চলছে৷
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ মানুষের জন্য সুপেয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে৷ বাংলাদেশের সামনে এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ কতটা?
আমাদের এখানে পানির অভিগম্যতা বেশিরভাগ লোকেরই আছে, সেটা ঠিক৷ কিন্তু যখনই আপনি ‘নিরাপদ' বিশেষণটা সেখানে বসাবেন, তখনই এখানে সমস্যা দেখা দিচ্ছে৷ বিভিন্ন রাসায়নিক ও জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়ে যাচ্ছে৷ সেগুলো যদি আমি বিবেচনায় নিই, তাহলে মাত্র ৩৫% লোক নিরাপদ পানি পাচ্ছে৷ বিবিএসের সঙ্গে ইউনিসেফের জরিপে এসেছে এই তথ্য৷
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৬ অনুযায়ী আমরা যদি ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য পানি নিশ্চিত করতে চাই, যার এক নম্বরটি হলো নিরাপদ পানি৷ সেটা হলো, সবার জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে৷ এক্ষেত্রে পরিমাণ নিশ্চিতের পাশাপাশি জীবাণুবিহীনও হতে হবে৷ তার অন্তত ২৫ লিটার পেতে হবে প্রতিদিন৷ পাশাপাশি মল-বর্জ্য পরিশোধন বা সেখান থেকে পানিকে নিরাপদ রাখতে হবে৷
সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদী যে পরিকল্পনা আছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত- সেখানে নগর ও পল্লী এলাকার সবার জন্যই ২০২৫ সালের মধ্যে নিরাপদ পানি নিশ্চিতের কথা বলা আছে৷ আর্সেনিক দূরীকরণের জন্যও চার বছর মেয়াদী একটা পরিকল্পনা আছে৷ কিন্তু আমাদের অনেক পরিকল্পনা থাকলেও সেটার জন্য স্পেসিফিক কোনো বাজেট নাই৷
আমাদের বাজেটে দেখবেন, নিরাপদ পানি ও নিয়ে আলাদা কোনো বাজেট সেখানে পাওয়া যায় না৷ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ভেতরে কোথাও এটা থাকে৷ সুতরাং আমরা বলতে চাই, নিরাপদ পানি নিশ্চিতের জন্য কর্মসূচি ও বাজেট দুটোই লাগবে৷ তাহলে আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব৷