তবু ধর্মগুরুতেই ভরসা!
২৬ এপ্রিল ২০১৮শেষতম উদাহরণ আসারাম বাপু৷ ছিলেন চাওয়ালা, রিকশাচালক৷ সেখান থেকে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে চমকপ্রদ উত্থান৷ গুজরাটের সবরমতী নদীর ধারে একটি সাদাসিধে আশ্রম থেকে শুরু করে এখন এক বিশাল সাম্রাজ্য! চার দশকে বিশ্বের ১২টি দেশে ৪২৫টি আশ্রম৷ ভারতে ৫০টিরও বেশি ‘গুরুকূল', বা আবাসিক স্কুল চালায় আসারামের আশ্রম৷ তারই একটিতে বছর দশেক আগে দুই নাবালক ছাত্রের মৃতদেহ পাওয়ার পর প্রথম শোরগোল হয়৷ নিহত দুই ছাত্র, যারা দুই ভাই ছিল, তারা আসারাম বাপুর কালো জাদু চর্চার বলি হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন ওদের বাবা-মা৷ সেযাত্রায় বেঁচে গেলেও নাবালিকা ধর্ষণের মামলায় আর শেষরক্ষা হলো না৷ আসারাম এবং তার সুপুত্র, দু'জনেই গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেলেন এবং শেষ পর্যন্ত বিচারে আসারাম দোষীও প্রমাণিত হলেন৷ তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হলো সদ্য৷
কিন্তু এই ধর্ষণ মামলার তদন্তের সূত্রে আশ্রমের ভেতরে বাবাজির যে কাণ্ডকারখানার নমুনা খুঁজে পাওয়া গেল, তা এককথায় ভয়াবহ৷ বেপরোয়া যৌন ব্যাভিচার আর নিপীড়নেরঅজস্র উদাহরণ৷ এবং আদৌ ধর্মীয় সংগঠন নয়, বরং পুরোদস্তুর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আশ্রমের কাজকর্ম চালিয়ে ৪০ বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়েছেন এই আসারাম বাপু৷ এর সঙ্গে আছে হাজার হাজার একর জমি, যার কিছু অংশ অবৈধ উপায়ে আত্মসাৎ করা৷ আসারামের কুকীর্তি অবধারিতভাবেই মনে পড়িয়ে দিচ্ছে আরেক স্বঘোষিত ধর্মগুরু গুরমিত সিং রাম রহিমের কথা, যার ডেরা ছিল যৌন অনাচারের আখড়া৷ কিন্তু তারও শেষরক্ষা হয়নি৷ তিনিও এক ধর্ষণের মামলায় দোষী প্রমাণিত হয়ে সম্প্রতি জেলে গেছেন৷
এরপর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এই ধর্মগুরুদের কি আর বিশ্বাস করতে পারবেন ভক্তরা? উত্তর খুঁজতে গিয়ে অবাক হতে হলো৷ পেশাদার জীবনে অত্যন্ত সফল বিপণন বিশেষজ্ঞ ত্বমেকা রায়চৌধুরি ব্যক্তিজীবনে খুবই ধর্মবিশ্বাসী এবং তাঁদের একজন পারিবারিক গুরুদেবও রয়েছেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ধর্ম বিশ্বাস যেহেতু নেহাত অন্তরের ব্যাপার এবং তিনি জন্ম থেকেই ঐ গুরুদেবের কাছে যাচ্ছেন, তাঁর বিশ্বাস টলেনি৷ কিন্তু এটাও ঠিক যে কয়েকজন ধর্মগুরুর কুকীর্তির জন্য সবার সম্পর্কেই প্রশ্ন উঠে আসছে৷ যেমন একটি ঘটনার কথা জানালেন ত্বমেকা, যে তাঁদের গুরুদেব একবার ভক্তদের ডাকে প্যারিস যেতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু ভিসার দরখাস্ত করতে গিয়ে জানতে পারেন, কোনো ধর্মগুরুকে ইউরোপে যাওয়ার শেঙেন ভিসা দেওয়া হয় না৷ সমস্ত ধর্মের গুরুদের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম প্রযোজ্য৷ কারণ তথাকথিত ধর্মগুরুরা যা বলেন, যা করেন, তার সঙ্গে আধুনিক ইউরোপীয় মনন আদৌ খাপ খায় না৷ ফলে গুরুরা স্বাগত নন ফ্রান্সে৷
কিন্তু প্রশ্ন যদি তৈরি হয়, সন্দেহ যদি দানা বাঁধে মনের মধ্যে, তা হলেও কি গুরুর প্রতি ভক্তি অটল থাকে? পেশায় অর্থনীতিবিদ অশেষ সেনগুপ্ত চমৎকার একটা কথা বললেন যে তিনি এখনও তেমন কোনো পরিস্থিতিতে পড়েননি, এমন কোনো অসুবিধে তাঁর এখনও হয়নি যে, একজন গুরুর দরকার হতে পারে৷ কিন্তু ভবিষ্যতে যদি হয়, তা হলে একজন গুরুর কাছে তিনি নিজেকে সমর্পণ করতেই পারেন৷ ডয়চে ভেলের তরফ থেকে অশেষকে প্রশ্ন ছিল, যাঁরা গুরুবাদে বিশ্বাসী, তাঁদের অনেকেই বেশ অর্থবান, বা ক্ষমতাশালী৷ তাঁদের কিসের অসুবিধা? অশেষের বক্তব্য, তিনি শুধু আর্থিক অসুবিধের কথাই বলতে চাননি৷ আরও অনেক সংকট আছে, যার থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষ গুরুর শরণ নেয়৷
সম্ভবত এই কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মূল সমস্যার জায়গাটা৷ মানুষের যতদিন সেই আত্মিক সংকটের জায়গাটা থাকবে, কোনো আসারাম বাপু, বা গুরমিত সিং রাম রহিমের কেচ্ছা আঁচড় কাটতে পারবে না অখণ্ড গুরুভক্তিতে৷