তসলিমার সমর্থন ও বিরোধিতায় পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী মহল
১০ নভেম্বর ২০১৮তসলিমা নাসরিন বিতর্কের আরেক নাম৷ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে হুংকার থেকে ব্যক্তিগত সম্পর্কের একান্ত মুহূর্ত লেখায় তুলে আনা, নানা কারণে তিনি আলোচিত ও বিতর্কিত৷ স্বদেশ বাংলাদেশ থেকে তো বটেই, কলকাতাতেও ঠাঁই নেই ‘লজ্জা'র লেখিকার৷ বাম সরকারের আমলে তাঁকে কলকাতা ছাড়তে হয়েছিল, আজও এই বাংলার দরজা তাঁর সামনে বন্ধ৷
তসলিমার ফেসবুক পোস্টে তাই স্বভাবসিদ্ধ রূঢ় ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী সমাজকে৷ সবচেয়ে জোরালো আক্রমণ রাজ্যের তৃণমূল সরকারের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে৷ যদিও সবাইকে এক বন্ধনীতে এনে তিনি লিখেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের মধ্যে এথিক্স বলে হয়তো এককালে, তিরিশ বা চল্লিশের দশকে, কিছু ছিল৷ এখন একেক জন সরকারের চাটুকার বনে যাচ্ছেন, সে যে সরকারই হোক৷'' তাঁর অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকরা বাংলাদেশের তসলিমা-বিরোধী সমাজে বই বিক্রি করার জন্য তসলিমার বিরুদ্ধে নোংরা, নিকৃষ্ট কথা বলছেন৷ এই অভিযোগ তুলে তসলিমা ফেসবুকে তাঁর সম্পর্কে করা পশ্চিমবঙ্গের অনেক সাহিত্যিকের মন্তব্য পোস্ট করেছেন৷ সেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার থেকে অনিল বিশ্বাস, আজিজুল হক, মহম্মদ সেলিমের মতো ব্যাক্তিরা আছেন৷
তালিকায় রয়েছেন কবি সুবোধ সরকারও৷ তসলিমার কঠোর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘উনি নিজে কোথায় কোথায় চাটুকারিতা করেছেন, আগে সেটার উত্তর দিন৷ পশ্চিমবঙ্গে কার কার চাটুকার ছিলেন, সেটা মানুষ জানেন৷ ওকে নিয়ে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাধে৷ যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মানুষকে কুৎসা রটিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, নিজের বাবার সম্পর্কে এসব লেখে, তাকে আমি আর মানু্ষ বলে ভাবি না৷''
তসলিমার লেখার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে তাঁর সঙ্গে বিশিষ্টজনদের সম্পর্কের কথা৷ সেই সূত্রে তিনি পোস্টের একাংশে মি-টু প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন৷ তসলিমা বলেছেন, ‘‘আজকে মি-টু আন্দোলনকে স্বাগত জানাবে, অথচ বিখ্যাত এক পুরুষের যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আছে বলে দ্বিখণ্ডিতকে গালি দেবে— এ হিপোক্রেসি ছাড়া কিছু নয়৷'' তসলিমার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্কের আখ্যান প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে৷ অনেকে তাঁর স্পষ্টভাষণকে সমর্থনও করেছেন৷ তাতে বোঝা যায়, পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক মহলে তসলিমার সমর্থকও আছেন৷ সাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কখন আমি কোন কথাটা বলব, সেটা আমার নিজস্ব ব্যাপার৷ তসলিমা দ্বিখণ্ডিত-তে যাঁদের নাম করে লিখেছেন, সেটা তাঁর অধিকারের মধ্যে পড়ে৷ পরিষ্কার অধিকারের মধ্যে পড়ে৷ তখন বলতে পারেননি, এখন বলেছেন৷ এতে কোনো অন্যায় নেই৷ এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা উচিত নয়৷ যাঁর সাহস আছে, যাঁর নাম নেওয়ার ক্ষমতা আছে, সে নাম নিয়েছে৷ বেশ করেছে৷ আবার যদি বলেন, বেশ করবেন৷''
কিন্তু নিজের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা কি প্রকাশ্যে আনা শোভনীয়? সঙ্গীতার মত, ‘‘অনেকে একান্ত মুহূর্তের কথা লিখতে পারেন, অনেকে পারেন না৷ এটা তসলিমার রুচির ব্যাপার, উনি লিখেছেন৷ কখনো হয়তো আক্রোশ বা প্রতিশোধবশত লিখেছেন, কখনো আবার প্রতিবাদ জানাতে লিখেছেন৷ তবে এর সঙ্গে মি-টু-র প্রসঙ্গ গুলিয়ে ফেললে হবে না৷ তাঁকে যদি কেউ বাজে প্রস্তাব দিয়ে থাকেন, সেটা তিনি লিখতেই পারেন৷ লিখবেন না-ইবা কেন? তসলিমা তো অনেক আগে থেকেই এসব লিখছেন৷ তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন৷ মেয়েদের চিন্তা-ভাবনা কোনদিকে যাবে, কোনদিকে যাওয়া উচিত, সে ব্যাপারে পথ দেখিয়েছেন৷''
পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা সরকারের সুনজরে থাকার চেষ্টা করছেন, এ অভিযোগে নতুনত্ব কিছু নেই৷ বর্তমান ও অতীতে বিরোধী দলের তরফে এই অভিযোগ তোলা হয়েছে৷ তসলিমার মন্তব্যকে কিছুটা পরিশীলিতভাবে তুলে ধরেছেন সংস্কৃতি কর্মী, অভিনেতা বাদশা মৈত্র৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের এই সময় দাঁড়িয়ে আরো বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল, যেটা তাঁরা করছেন না৷ তাঁদের নিজেদের সচেতন হওয়া ও অন্যদের সচেতন করার প্রয়োজন ছিল৷ অনেকেই বিভিন্ন বিষয়ে অনেক বেশি মুখর ছিলেন৷ আমরা এখন একটা নৈঃশব্দের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি৷ তাঁদের নীরবতা আমাকে পীড়া দেয়৷''
তসলিমার ফেসবুক পোস্ট পড়ে বোঝা যায়, পশ্চিমবঙ্গের সব বুদ্ধিজীবীকেই তিনি এক আসনে বসিয়ে ফেলেছেন৷ এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার৷ সঙ্গীতা ও বাদশার মতো তিনিও তসলিমার প্রশংসা করেছেন৷ কিন্তু তাঁর বক্তব্য, ‘‘সব বুদ্ধিজীবী সরকারের চাটুকার নন৷ এটা তসলিমার জানা উচিত৷ সরকারের সমর্থকদের হয়তো বেশি সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাওয়া যায়৷ তাঁরা অনাচার সত্বেও মুখবন্ধ করে থাকেন এটা ঠিকই, কিন্তু সরকারবিরোধী বুদ্ধিজীবীরাও আছেন৷ তাঁরা সরকারের সমালোচনা করেন৷ শঙ্খ ঘোষও সরকারের সমালোচক৷ তাঁকেও যদি তসলিমা আক্রমণ করে থাকেন, তাহলে বড় ভুল করেছেন৷''
তাহলে কেন তসলিমার বই কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় না? কেন তাঁকে দিল্লিতে থাকতে হয়? যে তসলিমা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘কলকাতা ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো শহর আমার মতো বাঙালি লেখকদের বসবাসের জন্য উপযুক্ত মনে হয়নি৷'' পবিত্র সরকারের জবাব, ‘‘তসলিমার কলকাতার সাহিত্য জগৎ থেকে নির্বাসনের জন্য দায়ী এখানকার প্রকাশকরা৷ তাঁরা বর্তমান সরকারকে ভয় পান৷ আগের সরকারকেও ভয় পেতেন৷ কেউই সংখ্যালঘুদের চটাতে চায় না, মৌলবাদকে ভয় করে৷ এতে বুদ্ধিজীবীদের কোনো দায় নেই৷''
উগ্র মৌলবাদের বিরুদ্ধে তসলিমার লড়াই পশ্চিমবঙ্গেও প্রশংসা পেয়েছিল, সেটা অস্বীকার করেননি সুবোধ সরকার৷ তিনি বলেন, ‘‘তসলিমাকে এক সময় আমরা মৌলবাদের বিপক্ষে শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলাম৷ কিন্তু তিনি নিজেই সেটাকে গুলিয়ে ফেলেছেন৷ নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা জলাঞ্জলি দিয়েছেন৷ সংখ্যালঘুদের পক্ষে ওঁর সওয়াল একটা রাজনৈতিক কৌশল৷ নারী অধিকারের পক্ষে, মেয়েদের জন্য উনি যে কান্নাকাটি করেন, সেটাও আসলে নিজের জন্য কান্নাকাটি৷''
মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই ও নির্বাসন প্রসঙ্গে পবিত্র সরকারের মন্তব্য, ‘‘মৌলবাদের বিরুদ্ধে তসলিমা একটা বড় লড়াই করেছেন৷ সে জন্য তাঁর প্রতি আমাদের সমর্থন ছিল এবং আছে৷ এজন্য তিনি শ্রদ্ধাও অর্জন করেছেন৷ রাষ্ট্রশক্তি ভোটের কথা ভাবে বলে তার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ তাঁর পক্ষেই রয়েছে৷ তিনি সবটা জানেন না বলে এসব মন্তব্য করেছেন৷ এর অর্থ, তসলিমা সবসময় যুক্তিবাদের পক্ষে থাকেন না৷ অনেক সময় আবেগপ্রবণ হয়ে বেশি কথা বলে ফেলেন৷''
তসলিমা প্রসঙ্গ এতটাই স্পর্শকাতর যে, এ ব্যাপারে মন্তব্যের জন্য ডয়চে ভেলে যোগাযোগ করলেও সাহিত্যিক আবুল বাশার, সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম কিছু বলতে চাননি৷ বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক মহলে যে টানাপোড়েনই থাক, এই বাংলার পাঠকদের মধ্যে এখনও তসলিমাকে নিয়ে কৌতূহল রয়েছে৷ তাঁর অধিকাংশ লেখার চাহিদা রয়েছে বইপাড়ায়, বইমেলায়৷ পাঠকদের প্রশ্ন, কেন রুদ্ধ করা হবে সাহিত্যিকের লেখনী? কেন মৌলবাদের সামনে মাথা নিচু করবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র?
তসলিমা নাসরিন মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকরা এখন সরকারের চাটুকার৷ প্রিয় পাঠক, আপনিও কি তাই মনে করেন? আপনার মন্তব্য লিখুন নীচের ঘরে...