তাঁদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে গরু ও গন্না
১৬ এপ্রিল ২০১৯আয়তন ও সংসদে আসন সংখ্যার হিসেবে ভারতের সহচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশ৷ দেশের মোট ৫৪৩টি আসনের মধ্যে উত্তরের এই রাজ্য থেকে নির্বাচিত হন ৮০ জন প্রতিনিধি৷ একেকজন প্রার্থী নির্বাচন করেন গড়ে ১৬ লক্ষ ভোটদাতা৷ পাঁচ বছর আগের নির্বাচনে এই রাজ্য কার্যত ‘মোদী সুনামি'তে বয়ে গিয়েছিল৷ এককভাবে ভারতীয় জনতা পার্টি দখল করেছিল ৭১টি আসন৷ সঙ্গী ‘আপনা দল' পেয়েছিল আরো ২টি৷ এই রাজ্য থেকে মোট ৭৩টি আসন নিয়ে সিংহাসনে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ এ যাবৎ ভারতে ৭জন প্রধানমন্ত্রী উপহার দিয়েছে এই রাজ্য৷
গত কয়েকদিন ধরে রাজ্যটির ১১টি লোকসভা কেন্দ্র ঘুরে যা বোঝা গেল, তা হলো, উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাংশে এবার নির্বাচনের প্রধান ইস্যু হলো গরু ও গন্না (আখ)৷ সঙ্গে স্থানীয় আরো কিছু বিষয় থাকলেও মোটের ওপর এই দুই ইস্যুই ভোটারদের প্রভাবিত করছে বেশি৷
কৃষি প্রধান এই রাজ্যে আখ ও গম চাষ হয়৷ আখের দাম নিয়ে বিজেপি-শাসিত কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ‘ন্যূনতম সমর্থন মূল্য' ও ‘স্টেট অ্যাশিওর্ড প্রাইস' নির্ধারণ করেছে৷ যার ফলে যাঁতাকলে পড়েছে চিনি মিলগুলি৷ পরোক্ষে প্রভাব পড়েছে চাষিদের ওপর৷ এই অঞ্চলে আজও প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে চাষিদের৷ ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন গন্না বা আখ চাষিরা৷ পাশাপাশি আরো এক সমস্যার নাম গরু৷ প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পর ছেড়ে দেওয়া গরু৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বয়স্ক গরু পুষে তার খাবার জোগানো গরিব কৃষকের পক্ষে সম্ভব হয় না৷ এই গরুর সংখ্যা এতটাই বেশি যে, সরাসরি সমস্যায় পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে৷ পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো তো আছেই, সেই সঙ্গে বড় সমস্যা হলো, খাবারের আশায় কৃষকের ক্ষেতে ঢুকে পড়ে ফসল নষ্ট করে এমন গরুর দল৷ এদিকে, কেন্দ্রে ও রাজ্যে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতে গরু এখন ‘গো-মাতা'৷ গো-রক্ষার নামে গো-মাংস ভক্ষন, গরু বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে৷ উল্টে গো-শালা চালু করার কথা বলা হচ্ছে৷ স্বভাবতই মাংস বিক্রির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়েছেন৷ খাদ্যাভ্যাসে হস্তক্ষেপে ক্ষিপ্ত দেশের সংখ্যালঘু সমাজ৷ ফসল নষ্টের কারণে দিশেহারা সাধারণ কৃষক৷ পথচলতি মানুষও ভবঘুরে গরুর সমস্যায় জেরবার৷ সর্বোপরি ক্রমশ গরুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ও অর্থনীতির চক্র৷ নির্বাচনে এর প্রভাব কতটা পড়বে তা অবশ্য সময়ই বলবে৷
বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘুরে এসেছেন বাঙালি সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানালেন, ‘‘পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠভূমিতে ১১৯টি চিনি কল আছে৷ একদিকে দু-রকমভাবে আখের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে৷ অন্যদিকে চিনি বিক্রির উর্ধ্বসীমা ৩৪ টাকা বেঁধে দেওয়া হয়েছে৷ এর ফলে বিপুল পরিমাণ বকেয়া টাকার দায়ে কার্যত ধুঁকছে চিনি কলগুলো৷ স্বভাবতই সমস্যায় রয়েছেন কৃষকরা৷ গতবার এই অঞ্চল ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বিজেপি৷ সেই প্রথম বিজেপি সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করে সফল হয়েছিল৷ এবার জাতিগত পাটিগণিতের সঙ্গে সপা-বসপা-আরএলডির মহাজোটের রসায়ন কিন্তু বিজেপি'কে চিন্তায় ফেলেছে৷ পাশাপাশি স্থানীয় স্তরে গন্না (আখ) ও গরু দুটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এবার নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য৷ তাই সুকৌশলে দেশপ্রেম, পাকিস্তানে এয়ারস্ট্রাইক, অ্যান্টি স্যাটেলাইট মিশাইলে সাফল্যের মতো বিষয়গুলিতে প্রচার চালাচ্ছে বিজেপি৷ এতকিছুর পরেও তৃণমূল স্তরে স্থানীয় ইস্যুগুলো মানুষের মনে রয়েই গেছে৷''
এবার রাজ্যে ৭ দফায় ভোটগ্রহণ চলছে৷ প্রথম দফায় ১১ এপ্রিল ৮টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে৷ দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৮ এপ্রিল ভোটগ্রহণ হবে আরো ৩টি কেন্দ্রে৷ দ্বিতীয় দফার নির্বাচন হতে চলেছে মথুরা, আগ্রা ও ফতেপুর সিক্রিতে৷ এই তিনটি আসনও বিজেপি'র দখলে ছিল৷ এবার উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে মথুরায় বিজেপি প্রার্থী প্রখ্যাত অভিনেত্রী হেমা মালিনী৷ ফতেপুরে কংগ্রেস প্রার্থী আরেক প্রখ্যাত অভিনেতা রাজ বাব্বর৷ সমাজের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, হেমা মালিনী নয়, তাঁরা ভোট দেবেন প্রধানমন্ত্রী মোদীকে দেখে৷ অর্থাৎ, মোদী হাওয়া এখনও বইছে মথুরায়৷ আগ্রায় লড়াই মহাজোটের বহুজন সমাজ পার্টি বনাম বিজেপি'র৷ ওদিকে, ফতেপুর সিক্রি কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী রাজ বাব্বর চিন্তায় ফেলেছেন শাসক দলের নেতাদের৷
গতবার এই ১১টির সবকটিই ছিল বিজেপির দখলে৷ প্রশ্ন হলো, এবার কী হবে? নরেন্দ্র মোদী, তথা ভারতীয় জনতা পার্টিকে ক্ষমতাচ্যুত করার ডাক দিয়ে হাত ধরেছে এই রাজ্যের দুই প্রধীন প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজবাদী পার্টি (সপা) ও বহুজন সমাজ পার্টি (বসপা)৷ এই দুই দলের প্রধান অখিলেশ যাদব ও ‘বহেনজি' মায়াবতীর ‘মহাজোট'-এ শামিল হয়েছেন রাষ্ট্রীয় লোকদল (আরএলডি) প্রধান, তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিংয়ের পুত্র অজিত সিং৷
ক'দিন আগে গাজিয়াবাদ, গৌতমবুদ্ধনগর, মেরঠ, বাগপত, কৈরানা, মুজফ্ফরনগর, বিজনোর ও সাহারনপুর ঘুরে যে ছবি ধরা পড়েছে, তাতে স্পষ্টতই এই আসনগুলিতে বিজেপি'র জন্য মোটেই ‘কেক ওয়াক' নয়৷ মথুরা ছাড়া অনেকটা একই ছবি ধরা পড়েছে আগ্রা ও ফতেপুর সিক্রিতে৷ জাঠ, মুসলিম ও দলিত ভোট একমঞ্চে আসার ইঙ্গিত মিলছে, যা রাজ্যটির মূলত উচ্চবর্ণ ও বানিয়া ভোটব্যাঙ্কের ওপর নির্ভরশীল গেরুয়া শিবিরে ধসের সম্ভাবনার জন্য যথেষ্ট৷ ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেই মনে করছেন, পাঁচ বছর আগের মহাজোটের অস্ত্রে ‘মোদী সুনামি' এবার মৃদু বাতাসে পরিণত হয়েছে৷ অন্তত এই রাজ্যে৷ রাজধানী-লাগোয়া গাজিয়াবাদ ও গৌতমবুদ্ধনগরে পদ্মের রমরমা৷ মথুরায় গরু ও গন্না সমস্যা ছাপিয়ে যেতে পারেন হেমা মালিনী৷