তাদের করোনাজয়ের গল্প
৮ সেপ্টেম্বর ২০২০নাজমুল হাসান অপু একজন সদাহাস্যময় ক্রিকেটার৷ মাঠ, ড্রেসিংরুম হাসিতে মাতিয়ে রাখতে তার জুড়ি নেই৷ দর্শকদেরও মাতিয়ে রাখেন তিনি ‘নাগিন ড্যান্স’ করে৷ এইরকম হাসিখুশি অপু করোনাকালে একেবারে বদলে গিয়েছিলেন৷ এলাকার বন্ধুদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দূর্গতদের সহায়তা করার জন্য৷
নিজে হাতে চাল-ডাল কিনে এনেছেন, প্যাকেট করেছেন এবং বিলি করেছেন৷ কিন্তু এই কর্মযজ্ঞ শেষ করার আগেই অপু পেলেন দুঃসংবাদ-তার শরীরে বাসা বেঁধেছে করোনা ভাইরাস৷ থমকে যেতে হলো অপুকে৷ ফোনের ওপাশ থেকে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘আরেকটা লড়াই করতে হবে এখন৷’’
হ্যাঁ, এমন লড়াই অনেক ক্রীড়াবিদকেই করতে হয়েছে বা হচ্ছে৷ সেই নেইমার থেকে শুরু করে মাশরাফি, জুয়েল রানা বা অপুরা লড়াই করেছেন কোভিড-১৯ রোগের সাথে৷ শুধু বাংলাদেশেই লড়াইয়ের গল্পটা একেবারে ছোট নয়৷
ক্রিকেটারদের মনের লড়াই
বাংলাদেশের ক্রিকেটে কোভিড-১৯ প্রথম ছোবল দিয়েছিল এক সাবেক ব্যাটসম্যানকে৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সময়ের ওই তারকা ক্রিকেটার বাসায়ই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন৷ তার রেশ কাটতে না কাটতেই এলো নাজমুল হাসান অপুর খবর৷
অপু করোনার শুরু থেকেই নারায়ণগঞ্জে ছিলেন৷ নিজের বন্ধুদের নিয়ে একটা টিম করেছিলেন৷ জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে কাজ করছিলেন করোনার কারণে কাজ হারানো মানুষদের জন্য৷ প্রায় এক হাজার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন কমপক্ষে সাত দিনের মতো সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র৷ জেলা শহরের আশেপাশে গিয়েও কাজ করছিলেন তিনি৷ এর মধ্যেই করোনা আক্রান্ত হলেন নিজেই৷
আগের দিনও সবার কাছাকাছি গেছেন৷ একটু যখন জ্বর এলো, তখন নিজেরই কেমন সন্দেহ হলো৷ পরীক্ষা করানোর পর ২০ জুন জানা গেল আসলেই এই ভাইরাসের শিকার হয়েছেন তিনি৷ অপুর একটা সুবিধা ছিল, তিনি মানসিকভাবে শুরু থেকেই প্রস্তুত ছিলেন৷ তিনি বলছিলেন, ‘‘আমি যেহেতু মানুষের মাঝেই ছিলাম, লোকজন নিয়ে কাজ করছিলাম, তাই আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিলই৷’’
আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে সকলের দারুণ সমর্থন পেয়েছেন অপু৷ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)-র চিকিৎসকরা যোগাযোগ রেখেছেন সবসময়৷ চিকিৎসার যেন ত্রুটি না হয়, সেটা নিশ্চিত করেছেন৷ সেই সাথে সমর্থকরা যেভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও ফোন-ম্যাসেজে তার জন্য প্রার্থনা করেছেন, তাতে অপু খুবই মুগ্ধ৷
পুরোটা সময় বাসায়ই কাটিয়েছেন৷ নিয়ম মেনেছেন এবং চিকিৎসকদের পরামর্শ শুনেছেন৷ শেষ পর্যন্ত ১ জুলাই রিপোর্ট পান যে, শরীর থেকে বিদায় নিয়েছে এই ভাইরাস৷ এই পর্ব শেষে আবার মানুষের মাঝে মিশে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল৷ কিন্তু এর মধ্যে আবার ফিরতে হয়েছে অনুশীলনে৷
অপুর কাছাকাছি সময়েই করোনায় আক্রান্ত হন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক এবং বর্তমান সাংসদ মাশরাফি বিন মর্তুজা৷
করোনা শুরুর পর থেকে মাশরাফিকে নিজের নির্বাচনি এলাকায় কয়েকবার যেতে হয়েছে৷ কিন্তু যে সময়টায় আক্রান্ত হয়েছেন, সে সময় ঢাকার বাসাতেই ছিলেন৷ এর ক’দিন আগেই তার পরিবারের বেশ কয়েক জন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হন৷ তবে মাশরাফী স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তাদের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছেন৷ তবে তাতে কোনো কাজ হয়নি৷
সামান্য একটু শরীর ব্যাথা আর জ্বর হতেই তারও সন্দেহ হলো৷ টেস্ট করাতে দিলেন৷ ২০ জুনই খবর পেলেন-করোনা তাকেও ধরেছে৷
মাশরাফির একটা বড় সমস্যা ছিল অ্যাজমা৷ শ্বাসকষ্টের এই রোগ থাকার ফলে তাকে নিয়ে ভয়ও ছিল বেশ৷ বিসিবি থেকে দ্রুত যোগাযোগ করা হলো৷ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও ফোন দিলেন৷ আর প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবিএম আব্দুল্লাহ চিকিৎসা পরামর্শ দিচ্ছিলেন৷
মাশরাফি বলেছেন, সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার ছিল ছেলে-মেয়েকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া, ‘‘ওরা আমাকে ছাড়া তো মাঝে মাঝে থাকে৷ কিন্তু এবার বাবা-মা দু’ জনকেই ছেড়ে চলে যেতে হলো নড়াইলে৷ বাবা-মা দু জনকেই ছেড়ে যেতে খুব কান্নাকাটি করছিল৷ আমার হঠাৎ মনে হলো, ছেলে-মেয়ের সাথে এটা তো শেষ দেখাও হতে পারে৷’’
এই আতঙ্ক নিয়েই চলেছে অপেক্ষা৷ অপেক্ষাটা দীর্ঘতর হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে৷ এর মধ্যে কয়েক বার অ্যাজমার কারণে শ্বাসকষ্ট হয়েছে৷ ফলে ভয়টা আরো ঘিরে ধরেছে৷ অবশেষে ১৪ দিন পার হলে পরীক্ষা করাতে দিলেন৷ কিন্তু হতাশা ঘিরে ধরলো- পজেটিভ এলো ফলাফল৷ আরও অপেক্ষা৷ এই অপেক্ষার শেষ হলো ২৪ দিন পার করে এসে৷ অবশেষে করোনামুক্ত হলেন মাশরাফি৷
মাশরাফি মুক্ত হলেও এরপর পর্যায়ক্রমে তার স্ত্রী, ছোট ভাই, বাবা-মা; সবাই আক্রান্ত হয়েছেন৷ ফলে এই সাবেক অধিনায়কের করোনার সাথে লড়াইটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে৷
ফুটবলে করোনা-বজ্রপাত
বাংলাদেশের ফুটবলে যা ঘটলো, সেটাকে বলা যায় করোনা ভাইরাসের এক বিশাল ঢেউয়ের ধাক্কা৷
৮ অক্টোবর সিলেটে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল আফগানিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ৷ সেই ম্যাচের জন্য প্রস্তুত করতে ফুটবলারদের নেওয়া হলো গাজীপুরের এক রিসোর্টে৷ ৩১ জন ফুটবলার এবং বেশ কয়েক জন কোচিং স্টাফ ছিলেন সেখানে৷ প্রথমে তিন দফায় সকলকে করোনা ভাইরাস পরীক্ষা করানো হলো৷ ফলাফল আসতে শুরু করলেই হৈচৈ পড়ে গেল৷ শুধু দুই জন নয়; ১৮ জন ফুটবলার নাকি করোনা আক্রান্ত!
পত্রিকায় নাম এলো বিশ্বনাথ ঘোষ, এম এস বাবলু, নাজমুল ইসলাম, সুমন রেজা, মোহাম্মদ টুটুল হোসেন বাদশা, সোহেল রানা, শহীদ আলম, আনিসুর রহমান জিকো, মো. রবিউল হাসান, মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও সুশান্ত ত্রিপুরা, ফয়সাল আহমেদ ফাহিম, মানিক হোসেন মোল্লা, মঞ্জুরুর রহমান মানিক, মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, ইয়াসিন আরাফাত, বিপলু আহমেদ ও মাহবুবুর রহমান সুফিলের৷ এ ছাড়া সহকারি কোচ মাসুদ পারভেজ কায়সারের নামও শোনা গেল৷
এই এক ঝাঁক ফুটবলারের আক্রান্ত হওয়া নিয়ে অবশ্য বেশ রহস্যজনক একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো৷ ফুটবলারদের প্রায় কেউই বিশ্বাস করতে চাইলেন না যে, তারা আক্রান্ত হয়েছেন৷ এবং এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরতি টেস্ট করাতে গিয়ে বেশীরভাগেরই নেগেটিভ এলো!
ফলে এক ধরনের বিড়ম্বনায় পড়লেন তারা৷ করোনা রোগের নয়, করোনার প্রচারের কারণে বিড়ম্বনায় পড়তে হলো তাদের৷ খুব ভুগেছেন তারকা ফুটবলার মাহবুবুর রহমান সুফিল৷ তবে তার কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই৷ তিনি মনে করেন, কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটা খুব ভালোভাবেই সামলেছেন৷ তবে এর মধ্যেই তার পরিবারকে সামলাতে হয়েছে কিছু ঝামেলা, ‘‘আসলে আমাদের নাম-ছবি চলে আসলো তখন পত্রিকায়৷ আমার পরিবার তো এত কিছু বোঝে না৷ বিশেষ করে বাবা এরকম খবর দেখে খুব ভেঙে পড়লেন৷ ওনাকেও স্থানীয় লোকজন খুব উত্যক্ত করছিল৷ ওনাকে লোকেরা বললো, তুমি বাড়ি থেকে বের হবে না৷ ওনার সাথে কেউ মিশছিল না৷ উনি ভেঙে পড়েছিলেন৷ এমনকি রিপোর্ট আবার নেগেটিভ আসার পরও ওনার ঝামেলা পোহাতে হয়েছে৷’’
সুফিলের মতো অভিজ্ঞতা বেশ কয়েকজন ফুটবলারের হয়েছে৷ মিডফিল্ডার সোহেল রানা অবশ্য কোনো উপসর্গ না থাকার পরও রোগের জন্য নিজের চিকিৎসা চালিয়ে গেছেন৷ তিনি বলছিলেন, ‘‘আমার পজিটিভ আসার দু দিন আগেও একবার নেগেটিভ এসেছিল৷ আমাদের কারো কোনো উপসর্গ ছিল না৷ তারপরও আমি চিকিৎসকের পরামর্শ শুনেছি৷ আমাদের ফেডারেশন থেকে যেভাবে বলা হয়েছে, সেভাবে আইসোলেশনে ছিলাম৷ প্রচুর ভিটামিস-সিযুক্ত ফল খেয়েছি৷ আমি ধরে নিয়েছি, আক্রান্ত হয়েছি৷ সত্যি বলি, মানসিকভাবে খুব ধাক্কা খেয়েছিলাম৷ তবে দ্রুত আবার নেগেটিভ চলে আসায় স্বস্তি মিলেছে৷’’
শেষ পর্যন্ত অবশ্য ফুটবলারদের এই ক্যাম্পটা আর হয়নি৷ ফিফা অন্তত এক বছরের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে বাছাইপর্বের এই ম্যাচ৷ ফলে এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছুটি কাটাচ্ছেন ফুটবলাররা৷
সংগঠকদের প্রাণের ভয়
শুধু যে তরুণ ক্রীড়াবিদরা করোনা ভাইরাসের খপ্পরে পড়েছেন, তা তো নয়৷ এই সর্বগ্রাসী ভাইরাস বাংলাদেশের বেশ কয়েক জন প্রবীণ ও শ্রদ্ধেয় ক্রীড়া সংগঠককেও সংক্রমিত করেছিল৷ তাদের নিয়ে ভয় ছিল৷
তাদের বয়স হয়েছে, সাথে শরীরে আগে থেকে বাসা বেঁধেছিল বেশ কিছু অসুখ৷ ফলে তারা ঝুঁকিতে ছিলেন৷ এই মানুষগুলোর আক্রান্ত হওয়ার খবর তাই এক ধরনের আঘাত হয়েই এসেছিল ক্রীড়াঙ্গনে৷ তবে সুখবর হলো, এখন তারা সবাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন৷
সংগঠকদের মধ্যে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ও বাংলাদেশ আওয়ামী লিগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ)-র কোষাধ্যক্ষ ও আর্চারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজিব উদ্দিন চপল, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাবেক নির্বাহী সদস্য ও সাবেক তারকা ফুটবলার শেখ মোহাম্মদ আসলাম এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন কর্মকর্তা ও সাবেক জাতীয় দলের ফুটবলার বাদল রায়৷
শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলছিলেন, তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন৷ তারপরও খবরটা পেয়ে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিলেন, ‘‘আমি হাসপাতালগুলোতে বিভিন্ন উপকরণ বিলি করছিলাম৷ অনেকের সংস্পর্শে আসছিলাম৷ ফলে আক্রান্ত হতে পারি, এটা বুঝতেই পারছিলাম৷ তারপরও যখন শুনলাম পজিটিভ, সাহিত্যের ভাষায় আমার শরীরে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল৷ খুব দ্রুত মানিয়ে নিয়েছি৷ তেমন কোনো সমস্যা হয়নি৷’’
নাদেল সুস্থ হওয়ার পর প্রস্তুত ছিলেন প্লাজমা দানের জন্য৷ এখনও সে সুযোগ হয়নি৷ তবে এই অক্লান্ত ক্রিকেট সংগঠক আবারও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কাজে৷
কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কাজী রাজিব উদ্দিন চপলও৷ তিনি অবশ্য বেশ সতর্ক ছিলেন করোনা নিয়ে৷ দেশে করোনা আসার পর থেকে জরুরি কিছু কাজ ছাড়া বাসা থেকে বের হচ্ছিলেন না৷ তার হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ আছে৷ ফলে তিনি এই করোনা রোগটি থেকে দূরে থাকারই চেষ্টা করছিলেন৷ তারপরও আক্রান্ত হয়েছেন৷
তবে আক্রান্ত হওয়ার পর খুব মজায় সময়টা কাটিয়ে মানসিক চাপ থেকে দূরে ছিলেন, ‘‘আমার জন্য আক্রান্ত হওয়াটা একটু অপ্রত্যাশিত ছিল৷ তারপরও মেনে নিলাম৷ আমার দুই ছেলেও আক্রান্ত হয়েছিল৷ আমরা একসাথে মজা করেছি, ইনডোরে বিভিন্ন খেলা খেলেছি৷ যতটা পারি আনন্দে ছিলাম৷ কারণ, আমার মনে হয়েছে, একবার মনোবল ভেঙে গেলেই বিপদ৷ সেই বিপদটা কাটিয়ে উঠেছি৷’’
১ সেপ্টেম্বরের ছবিঘরটি দেখুন...