তিনি এক জঙ্গির মা
২৯ অক্টোবর ২০১৮২৭ বছরের ছেলে ক্রিস্টিয়ান মায়ের শেষ বারণটুকুও শুনলেন না৷ জার্মানি থেকে স্ত্রী ইয়াসমিনাসহ ইসলামিক স্টেট-এ যোগ দিতে পাড়ি জমালেন সিরিয়া৷
বেদনাদায়ক সাক্ষাৎ
ঘরেই থাকেন সাবিনে৷ খুব একটা বের হন না৷ তিনি একজন জঙ্গির মা৷ কেউ তাঁর ছেলের জন্য কাঁদে না৷ তবে তিনি কাঁদেন৷
‘‘আমি তাঁকে ভালোবাসি,'' বলেন সাবিনে৷ ‘‘তবে আমার ক্রিস্টিয়ান তো আর আগের মতো নেই৷''
খুব দ্রুত কথা বলেন এই হতভাগ্য মা৷ মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে কিছুটা অস্বস্তিও বোধ করেন৷ কয়েক ঘন্টায় অনেক কথা হলো তাঁর সঙ্গে৷
ভাগ্যের আঘাত ছোটবেলাতেই
সাবিনে জানালেন, তাঁর ছেলে ক্রিস্টিয়ান ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন৷ কিন্তু একা একা মানুষ করতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাঁকে৷ ছেলে যখন মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছিল, তখন পাশে দাঁড়িয়েছেন৷
টিনএজ বয়সেই খুব অসুখে পড়েন ক্রিস্টিয়ান৷ ওজন কমতে থাকে৷ এক রাতে পেটের পীড়ায় এতটাই কাতর হয়ে পড়েন যে, মা সাবিনে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যান৷ সে রাতেই অপারেশন করা হয়৷
আল্লাহ'র কাছে ফিরে আসা
সাবিনে'র মনে পড়ে, ক্রিস্টিয়ানের যেদিন অ্যানেস্থেশিয়া'র ঘুম ভাঙ্গে, সেদিন তিনি মাকে বলেন যে, তাকে দ্বিতীয় জীবন দেয়ায় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে চান৷ তাঁরা ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারী ছিলেন৷ সালাফিজম তো দূরে থাক, ইসলামের সঙ্গেই কোনো সম্পর্ক ছিল না৷
সুস্থ হয়ে স্কুলে ফেরত যায় ক্রিস্টিয়ান৷ সেখান থেকে পাশ করে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে ভর্তি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ স্কুলেই মরক্কো ও তুর্কি বংশোদ্ভুত কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় ক্রিস্টিয়ানের৷ ইসলামের প্রতি তাদের নিষ্ঠা মুগ্ধ করে ক্রিস্টিয়ানকে৷
২০১২ সালে একদিন ঘরে ফিরে এসে মা-কে কিছু কথা বলতে চান৷ সাবিনে'র ভাষায়, ‘‘ও হঠাৎ করে বাড়ি ফিরল এবং আমাকে বলল যে, সে ধর্মান্তরিত হতে চায়৷''
সাবিনে'র জীবনসঙ্গী তখন মারা গেছেন৷ তিনিও জীবন নিয়ে নতুন কিছু ভাবতে চাইছিলেন৷ ছয় মাস পর দু'জনই ফিরলেন ‘আল্লাহর কাছে'৷
মতবিরোধ শুরু
সাবিনে যখন ঘর থেকে বেরুতেন, হিজাব পরতেন৷ তবে নিকাব দিয়ে মুখ ঢাকতেন না৷
‘‘আমরা জার্মানিতে থাকি৷ এখানে এই বিষয়টা ঠিক যায় না,'' এমনটাই ভাবতেন সাবিনে৷ এমনকি বাজারে লোকজনের সঙ্গে আগের মতোই হ্যান্ডশেকও করতেন৷
কিন্তু ক্রিস্টিয়ানের এগুলো ভালো লাগত না৷ তিনি দিন দিন আরো রক্ষণশীল হতে লাগলেন৷ মা-কে বকা দিয়ে বলতেন, ‘‘মা, এমন কোরো না, এগুলো হারাম৷''
এভাবে তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিতে লাগল৷
‘অন্যের শেখানো বুলি'
সে সময় আরো অনেক কিছু সাবিনে'র ভালো লাগত না৷
‘‘আমি দেখলাম, মেয়েরা সেসব কথাই বলে, যেসব তাদের স্বামীরা শিখিয়ে দিচ্ছে,'' বলেন তিনি৷ ‘‘আমি তাদের অনেক কথাতেই প্রশ্ন করতাম এবং বলতাম, নিজে কোরআন পড়ুন, শুধু অন্যের শেখানো বুলি আওড়াবেন না৷''
এ কথাগুলো পুরুষদের ভালো লাগত না৷ তারা ক্রিস্টিয়ানকে বলতেন, ‘‘তোমার মা'কে পথে আনো৷ সে আমাকে চুপ থাকতে বলত৷''
ইয়াসমিনা'র সঙ্গে পরিচয়
২০১৪ সালে এক জার্মান মরোক্কান নারীর সঙ্গে পরিচয় হয় ক্রিস্টিয়ানের৷ ‘‘আসলে আমিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম,'' বলেন সাবিনে৷ কোনো একদিন জুম্মার নামাজের পর ১৭ বছরের ইয়াসমিনা সাবিনের কাছে এসে ক্রিস্টিয়ানের খোঁজ করেন৷ কারণ হিসেবে বলেন যে, একজন প্রকৃত ইসলামের অনুসারীকে বিয়ে করতে চান৷
তখন সাবিনে বুঝতে পারেননি যে, ইয়াসমিনা এমন কাউকে বিয়ে করতে চান, যাকে নিয়ে সিরিয়া যেতে পারবেন৷ সাবিনে'র দৃঢ় বিশ্বাস যে, ক্রিস্টিয়ানের উগ্রপন্থার পথ বেছে নেয়ার কারণ ইয়াসমিনা৷
ছয় মাস পর ফ্রাঙ্কফুর্টের এক মসজিদে বিয়ে করেন ক্রিস্টিয়ান ও ইয়াসমিনা৷ ২০১৫ সালের শুরুতেই ইয়াসমিনা সাবিনেকে জানান যে, তিনি ও ক্রিস্টিয়ান ইসলামিক স্টেট-এ যোগ দেবেন৷
‘‘দুর্ভাগ্যবশত, আমি তখন অত গুরত্ব দেইনি৷ ভেবেছি, এইটুকু মেয়ে!'' বলেন সাবিনে৷
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে
ততদিনে আসলে ইয়াসমিনা ও ক্রিস্টিয়ান তাদের সিদ্ধান্ত নেয়া পথে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন৷ তারা ডর্টমুন্ড ও তার বাইরে ইন্টারনেট ক্যাফেতে বসে যোগাযোগ করতেন৷
জার্মানির সালাফিস্ট নেতাদের অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ গড়ে ওঠে ক্রিস্টিয়ানের৷ ২০১৫ সালের জুলাইতে ক্রিস্টিয়ান সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন৷ তবে যাওয়ার আগেই ডর্টমুন্ড পুলিশের নজরদারিতে পড়েন তিনি৷ এমনকি আজ পর্যন্ত সাবিনেও পুলিশের নজরদারিতে আছেন৷
কয়েকবার তাঁর ফোন পুলিশ জব্দ করেছে৷ সাবিনে জানান যে, তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে অনেক সালাফিস্ট মতাদর্শের লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, যদি একটু ছেলের সম্পর্কে কিছু জানা যায়, এমনকি তার মৃত্যুর পরও৷
ইসলামিক স্টেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা
ক্রিস্টিয়ান ও ইয়াসমিনা চলে যাবার পর ক্রিস্টিয়ান প্রায়ই হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পাঠাতেন বা কল করতেন৷ ‘‘ও রাক্কা, ইডলিব, আবু কামাল এবং এমনকি একবার ইরাকেও ছিল,'' বলেন সাবিনে৷
ঠিক এক বছর পর একটি ভিডিও দেখে ধাক্কা খান সাবিনে৷ আইএসের সঙ্গে জড়িত অনলাইন প্লাটফর্ম ফুরাত মিডিয়াতে প্রকাশিত ভিডিওটিতে দেখা যায় যে, ক্রিস্টিয়ান, যার নাম তখন পরিবর্তন হয়ে আবু ইসা আল-আলামনি হয়ে গেছে, ইউরোপে হামলার আহ্বান জানাচ্ছেন৷
ভিডিওতে এরপর কুঠার দিয়ে এক ব্যক্তির হাত কেটে ফেলা হয়৷ পরিষ্কার ছিল না যে, তা ক্রিস্টিয়ানই করেছেন কি না৷ তবে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত'র কপালে চুমু খান৷ এমন দৃশ্য দেখে ক্রিস্টিয়ানকে পুরোপুরি অচেনা ঠেকে সাবিনে'র কাছে৷
পরে টেলিফোনে কথা বলার সময়, বিষয়টি নিয়ে চিৎকার করলে মা'কে উল্টো ‘অবিশ্বাসী' বলে গাল দেন ক্রিস্টিয়ান৷
ঐ কথোপকথনের পর সাবিনের শেষ আশাটুকুও মরে যায় যে, একদিন হয়তো পুত্র ভুল বুঝে ফিরে আসবে৷ তখন হয়তো ওর ১০ থেকে ১৫ বছরের সাজা হবে৷ তাতে কী? অন্তত দেখা তো হবে৷
একদিন হোয়াটসঅ্যাপে দু'টি ছবি আসে সাবিনের মোবাইলে৷ সেখানে একটি কালাশনিকভ রাইফেলের সঙ্গে প্রেগনেন্সি টেস্ট পজিটিভ হওয়ার ছবি এবং অন্য ছবিতে ছেলে ও বুরকা পরা ছেলের বৌ৷
মরুভূমিতে মৃত্যু
২০১৭ সালের ১ আগষ্ট ছেলের সঙ্গে সবশেষ কথা বলেন মা৷ তখন ছেলে জানান যে, তিনি যুদ্ধে যাচ্ছেন৷ যদি মারা যান, তাহলে ইরাকি যোদ্ধাকে বিয়ে করবেন ইয়াসমিনা৷ সব ব্যবস্থা করা আছে বলে জানিয়েছেন৷
১৯ সেপ্টেম্বর ছেলের স্ত্রী ইয়াসমিনা কল করেন৷ সগর্বে বলেন, আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে তার স্বামী ‘শহিদ' হয়েছেন৷
‘‘না, ক্রিস্টিয়ান আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করতে যায়নি৷ সে আল বাগদাদি (আইএস নেতা) ও তার অপরাধী সঙ্গীগুলোর জন্য যুদ্ধ করতে গিয়েছিল,'' বলেন সাবিনে৷
নাতি'র জন্য
এখন একজন একাকী মানুষ সাবিনে৷ তাঁর পরিচয় জানার পর মানুষও তাঁর সঙ্গে কথা বলতে খুব একটা চায় না৷ কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করেন, ‘‘আপনি কি ক্রিস্টিয়ান লাপ্পের মা?''
সাধারণত তিনি উত্তর দেন, ‘‘হ্যা, আমি ওর মা৷ কিন্তু আমি ভয়ঙ্কর নই৷ আমার হিজাবের নীচে কালাশনিকম রাখা নেই এবং আমি কারো হাত কাটি না৷''
তাঁর জীবনের এখন একটাই খায়েশ৷ নাতি'কে একবার কোলে নেবেন৷ কয়েকটি ছবি দেখালেন নাতির৷ বললেন যে, দেখতে একেবারে ক্রিস্টিয়ানের মতোই হয়েছে৷
‘‘আমার খালি মনে হতো, ক্রিস্টিয়ানকে হারিয়ে ফেলব৷ সত্যি হারিয়েছি৷ এখন আমার মনে হয়, এই ছোট্টটাকেও হারিয়ে ফেলব,'' দুঃখে বুক ভাসান সাবিনে লাপ্পে৷
এস্থার ফেলডেন/জেডএ