তিস্তা চুক্তি চূড়ান্ত করতে বদ্ধপরিকর মোদী
৩০ মার্চ ২০১৭শেখ হাসিনা সরকার যখন মৌলবাদী, আইএস, বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি, মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক-বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্রমাগত ব্যবস্থা নিয়ে চলেছে, ঠিক এমন একটা মুহূর্তেই তিস্তা জলবণ্টন চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর প্রকৃত সময়৷ আগামী ৭ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ভারত সফর রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার৷
ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ আমলা প্রত্যেকেই মনে করছেন, হাসিনার ভারত সফরে তিস্তা চুক্তি-সহ আরও অনেকগুলি চুক্তি বাস্তবায়িত হতে চলেছে৷ উভয় দেশেই সাধারণ মানুষের মনে এই বিষয়ে আশা-আকাঙ্খা জন্ম নিয়েছে৷ সব মিলিয়ে সদিচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে উভয় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরই৷ কিন্তু তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়িত করতে হলে নরেন্দ্র মোদীকে পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিম – এই দু'টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতি আদায় করতে হবে৷ আগে যা আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং৷ এখন অবশ্য আবারো নতুন করে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে৷ কিন্তু উভয় দেশের জনগণের মধ্যে এই চুক্তি নিয়ে জল্পনা যখন তুঙ্গে, তখন ঠিক অতীতের মতোই নিজের আপত্তি তুলে ধরেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷
তবে এ যাত্রায় মমতার আপত্তিকে সম্মতিতে বদলে ফেলার মতো অস্ত্র রয়েছে মোদীর হাতে৷ আর সেই অস্ত্র হলো, নারদ স্টিং অপারেশনে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই-এর তদন্ত৷ সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেসের সাত সাংসদ-সহ একাধিক মন্ত্রী ও বিধায়কের বিরুদ্ধে ঘুস-কাণ্ডের অভিযোগে সিবিআই-কে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে ভারতের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি জে এস খেহরের নেতৃ্ত্বাধীন তিন সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ৷ অন্যদিকে, ভারতের শাসক দল বিজেপির ‘মাদার’ সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ পশ্চিমবঙ্গে তাদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির স্বপ্ন দেখছে৷ এই পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল ও সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে নারদ-অস্ত্রকে ব্যবহার করতে চাইছে বিজেপি এবং আরএসএস৷
২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদীর সফরসঙ্গী হয়ে বাংলাদেশে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তারপর ছিটমহল বিনিময় নিয়ে স্থলসীমান্ত চুক্তিতে সায় দেন তিনি৷ গত ২৩ মার্চ একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই ভারত-বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তি নিয়ে প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন৷ বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশের জন্য যা করার করবো, তবে বাংলার স্বার্থ বাঁচিয়ে৷’’ তাঁর আশঙ্কা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁকে বাদ দিয়েই শেখ হাসিনার সঙ্গে তিস্তা চুক্তি চূড়ান্ত করে ফেলবেন৷ এমনটা হলে তিনি যে তা কিছুতেই মানবেন না সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা৷
বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে চাষাবাদের একটা বড় অংশ তিস্তার জলের ওপরে নির্ভরশীল৷ সেই তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি করার উদ্যোগ দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলেও নেওয়া হয়েছিল৷ কিন্তু ২০১১ সালে শেষ মুহূর্তে ঢাকা সফর বাতিল করেন মমতা৷ সেসময় তিনি অভিযোগ করেছিলেন, রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করেই তিস্তা চুক্তি নিয়ে এগিয়েছে মনমোহন সরকার৷ এবার মোদী সরকারের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগে সরব মুখ্যমন্ত্রী৷ তাঁর কথায়, ‘‘যেখানে রাজ্যের স্বার্থ, সেখানে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত৷ কিন্তু শুনছি ২৫ মে বাংলাদেশে গিয়ে তিস্তা চুক্তি হবে৷ অথচ আমি এখনও কিচ্ছু জানি না৷’’
কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস এখন কোণঠাসা হওয়ার কারণে প্রতিদিনই কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার মমতার ওপর চাপ বাড়িয়ে চলেছে৷ হাসিনা দিল্লিতে আসার সময়ই বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত করতে চাইছেন মোদী৷ এদিকে নানা মহলে যতই সংশয় থাক না কেন, নারদ নিয়ে কোনোরকম ঢিলেমির সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব৷ সারদা নিয়ে সিবিআই তদন্ত মাঝখানে গতি হারানোয় নানা প্রশ্ন উঠছিল৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর নারদ তদন্তের ভারও এখন সিবিআই-এর হাতে৷ এই প্রসঙ্গে বিজেপি নেতাদের স্পষ্ট কথা, সিবিআই নিঃসন্দেহে দ্রুত তদন্তের কাজ শেষ করবে৷ তাঁদের সাফাই, সিবিআই-এর কাজে কেন্দ্র হস্তক্ষেপ করে না৷ তাছাড়া এই মামলা নিয়ে প্রথমে হাইকোর্ট ও পরে সুপ্রিম কোর্ট অত্যন্ত কড়া মনোভাব নেওয়ায় সিবিআই কড়া হাতে তদন্ত সামলাবে এবং অভিযুক্তদের ছাড় পাওয়ার সম্ভাবনা নেই৷
‘‘ভারতীয় এবং বাঙালি হিসেবে আমি মনে করি, তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি শুধুমাত্র ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরও মধুর করবে তাই নয়, সেইসঙ্গে বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নে সাহায্য করবে৷ বাংলাদেশের যে অংশটি তিস্তা অববাহিকার মধ্যে পড়ে, সেই বিস্তীর্ণ অংশের গরিব মানুষ যদি জলের অভাবে চাষবাস করতে না পারে, তাহলে সেখানকার অসহায় গরিব মানুষ সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে আসবে৷ কাঁটাতার পার হতে গিয়ে ধরা পড়া হাজার হাজার মানুষকে ভারতের জেলে আটকে রেখে বিচার চলবে৷ এমন একটা অকল্পনীয় পরিস্থিতির তুলনায় ঢের বেশি ভালো তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি সম্পন্ন করে বাংলাদেশকে তাদের প্রাপ্য জল দেওয়া,’’ ভারতের সংসদ ভবনের পাঠাগারে বসে কথাগুলো বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জের সিপিআই (এম) সাংসদ বিদেশ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম৷
সূত্রের খবর, আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে একগুচ্ছ চুক্তি সই হতে চলেছে৷ বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম ছাড়াও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার, পায়রা বন্দরে মাল্টিপারপাস (কন্টেইনার) টার্মিনাল নির্মাণ, লাইটহাউজ ও লাইটশিপ, কোস্টাল ও প্রটোকল রুটে যাত্রী এবং ক্রুজ সার্ভিস সংক্রান্ত বিষয়ে দু'দেশের সচিব পর্যায়ের বৈঠকে যে সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত হয়েছে৷ এবার তা দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি হিসেবে রূপ নিতে চলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে৷ এছাড়াও গত বছরের ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় দু'দেশের নৌ-সচিব পর্যায়ের বৈঠকে যেসব বিষয়ে সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত হয়েছে, তা বিদেশমন্ত্রকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরেই দু'দেশের মধ্যে চুক্তি হয়ে যেতে পারে৷ ওদিকে দিন তিনেক আগে ঢাকায় বাংলাদেশের জলসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ তার ওপর ভিত্তি করেই প্রত্যাশা৷ আর সেটা থেকে ভারত বিচ্যুত হবে না৷’’
হাসিনার এই সফরে নরেন্দ্র মোদী দু'দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় হরকাতুল জিহাদ (হুজি) এবং জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-সহ বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর বাড়বাড়ন্ত রুখতে মোদী বাংলাদেশের সহযোগিতার ওপর জোর দেবেন৷ ভারতের লক্ষ্য বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা চুক্তি করা৷ এর ফলে বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি করা সহজ হবে৷ বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনে চীনের কাছ থেকে৷ গত নভেম্বরে বাংলাদেশকে দু'টি সাবমেরিন বিক্রি করেছে চীন৷ ভারত চাইছে চিনকে সরিয়ে সেই জায়গাটা দখল করতে৷ তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা দু'দেশের তিস্তা জলবণ্টন চুক্তির ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করে রয়েছে বলে মনে করছেন উভয় দেশের কূটনীতিকরা৷
প্রিয় পাঠক, এই বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন নীচে মন্তব্যের ঘরে...