তৃতীয় লিঙ্গের পক্ষে বার্তা দিলো ‘নগরকীর্তন’
৭ মার্চ ২০১৯খ্যাতনামা বাঙালি পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক ছবি ‘নগরকীর্তন'-এ রূপান্তরকামী সমাজের অনেক কথাই বলা হয়েছে৷ কেন্দ্রীয় চরিত্র পুঁটি ওরফে পরিমলের কাহিনি মিলে যাচ্ছে অনেকের জীবনের সঙ্গে৷ পুঁটিকে ‘পুরুষের শরীরের খাঁচায় বন্দি নারী মন'-এর জন্য বাড়ি ছাড়তে হয়৷
এমনই গল্পতো উৎসব গঙ্গোপাধ্যায়েরও৷ লেক গার্ডেন্সের উৎসব যেদিন বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন, সেদিন ঠাকুমার ব্লাউজ, মায়ের শাড়ি আর প্রতিবেশীদের নকল চুল, লিপস্টিক খোয়া গিয়েছিল৷ উৎসবের মা অপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায় সেদিন এ সবের মানে কিছুই বুঝতে পারেননি৷ তারপর আস্তে আস্তে সমাজটাকে একটু একটু করে পালটাতে দেখেছেন তিনি৷ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় বেরোনোর পর রূপান্তরকামী বা ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কে তাঁরও ধারণা গড়ে উঠেছে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘আমার কোনো লজ্জা নেই বলতে যে উৎসব আমার মেয়ে৷ আমি খুব সাধারণভাবেই বলতে পারি, আমার এক ছেলে, এক মেয়ে৷''
আবার উৎসবের মতোই অতীত ব্যারাকপুরের মেকআপ শিল্পী ও মডেল অদিত্রি চৌধুরীর৷ তিনি জন্মেছিলেন ছেলে হয়ে৷ কিন্তু তাঁর মহিলাতে রূপান্তরের সার্জারিকে মেনে নিয়েছেন তাঁর মা মীনা চৌধুরী আর বাবা নন্দলাল চৌধুরী৷ তাঁরা রূপান্তরকামিতা নিয়ে কোনো ছুঁৎমার্গ রাখেননি৷ তাঁরা সন্তানের পরিস্থিতি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন৷ এমন অজস্র নমুনা ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের চারপাশে৷
কী বলছেন বিশিষ্টরা?
এলজিবিটি সম্প্রদায়ের জন্য ছবি এর আগেও হয়েছে৷ ২০১০ সালে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি ‘আরেকটি প্রেমের গল্প'-র মতো দর্শকদের আকৃষ্ট করেছিল ঋতুপর্ণ ঘোষ অভিনীত ‘চিত্রাঙ্গদা' বা ‘মেমোরিজ ইন মার্চ'৷ কিন্তু ২০১৯-এর ‘নগরকীর্তন' ছবিটি পেয়েছে আরও বেশি জনপ্রিয়তা৷ অনেকেই বলছেন, তৃতীয় লিঙ্গের ছক-ভাঙা জীবন এর থেকে পাচ্ছে সাহস এবং লড়াই করার উৎসাহ৷ ছবি সম্পর্কে পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘রূপান্তরকামী মেয়ে-পুরুষেরা দলে দলে আমার নগরকীর্তন ছবিটা দেখতে আসছেন৷ খোলাখুলি আলোচনা করছেন৷ ২০১০-এ ‘আরেকটি প্রেমের গল্প'-ও দর্শকদের মন ছুঁয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু তখন তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদের ভিড় এতটা দেখিনি৷''
চলচ্চিত্র সমালোচক নির্মল ধর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সমকামী বা ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে এইসব ছবি আরও বেশি করে করা উচিত৷ কৌশিক সেটাই করেছেন৷ তাতে আমাদের দৃ্ষ্টিভঙ্গি কিছুটা হলেও বদলাবে৷ এর আগে ঋতুপর্ণ ঘোষের হাত ধরে এই বিষয় নিয়ে বাংলায় ছবি হয়ে থাকলেও সেখানে উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষদের দুঃখ-কষ্ট দেখানো হয়েছে৷ কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবিতে রাস্তার বৃহন্নলাদের জীবন বা আম রূপান্তরকামীর জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে, তাতে কোথাও দুঃখবিলাস নেই৷ এই ছবিটা হয়তো আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনার সূচনা করবে৷''
এই ছবি মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে, এ কথা মনে করেন সাহিত্যিক-সমালোচক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি বলেন, ‘‘অতীতের অনেক সংস্কার থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি৷ তেমনভাবেই সভ্যতাকে নতুন দিক মেনে নিতে হবে৷ দুটো একই লিঙ্গের মানুষ, তাদের মধ্যে একজন একটু বেশি মেয়েলি, এই প্রেমটাও তো প্রেম৷ সেই জন্যই বাংলায় প্রথম এমন একটা প্রেমের ছবি দেখলাম যার সঙ্গে কোনো ছবি তুলনীয় নয়৷''
গোঁড়ামি কি দূর হবে?
অতীতে পরিচালক ওনিরের ‘মাই ব্রাদার নিখিল' কিংবা গত বছরের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘ইভনিং শ্যাডোস' - এইসব ছবিগুলি তুলে ধরছে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের সুখ-দুঃখ৷ এই ছবিগুলি অভিভাবকের সঙ্গে তাঁদের ভিন্ন ধারার সন্তানদের টানোপড়েনের গল্প বলেছে৷ অদিত্রি চৌধুরীর মতো ভাগ্য সকলের হয় না৷ সকলেই পাশে পরিবারকে পান না৷ তাই প্রশ্ন উঠছে, চলচ্চিত্র কি পারবে সমকামিতা, রূপান্তরকামিতা নিয়ে সামাজিক ট্যাবু তথা গোঁড়ামি দূর করতে?
এ ব্যাপারে রূপান্তরিত নারী অভিনেত্রী তিস্তা দাস ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘ফিল্ম, স্টেজ, অভিনয় একটা জোরালো মাধ্যম৷ এর মাধ্যমে অনেক বড় বার্তা দেওয়া যায়৷ তবে কিছু মানুষ থাকে, যারা কোনো কিছুতেই মানবে না৷ কিন্তু তাদের কথা না ভেবে চেষ্টাতো করা উচিত৷ ফিল্মও সেই চেষ্টাটাই করে৷ তবে শুধু একটা ছবিতে কিছুই হবে না৷''
রূপান্তরকামীদের সহায়তার জন্য তিস্তার নিজের একটি সংগঠন আছে৷ সেখানে তিনি কাউন্সেলিংও করেন৷ তিস্তার কাছে রূপান্তরকামীদের অনেকেই সামাজিক, মানসিক সমস্যা নিয়ে যান৷ সেই ব্যাপারে তিস্তা বলেন, ‘‘অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যাপ্রবণও হয়ে পড়েন৷ ১০০ জনের মধ্যে ৪ জনের এই সমস্যা আছে৷ পরিবার বা সমাজকে সচেতন করতে আরও ছবি তৈরি করতে হবে৷ এলজিবিটিদের সমস্যা যাঁরা বুঝছেন, তাঁরা সংখ্যালঘু, সংখ্যাগরিষ্ঠরা কিন্তু বোঝেন না৷ এজন্য পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে৷ পরিবারকে বুঝতে হবে সমস্যাটা কোথায়! সমাজকে সচেতন করার পাশাপাশি পরিবারের পাশে থাকাটাও কিন্তু দরকার৷''
পরিবর্তনের পথে এক পা
চলচ্চিত্র আর বাস্তবের মধ্যে মিলের মতো অমিলও আছে প্রচুর৷ পশ্চিমবঙ্গ ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিনহা বলেন, ‘‘দীর্ঘ কুড়ি বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি নানা ঘটনায় রূপান্তরকামীরা অত্যাচারিত হয়৷ ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাঁদের আত্মহত্যারও নজির প্রচুর আছে৷ সেই হিসেবে এমন প্রেমের ছবি করাকে স্বাগত জানাই৷ তবে আমার মনে হয়, শেষটা আরেকটু আশাবাদী হলে সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটা আশার বার্তা যেত৷ তবে সিনেমা এককভাবে মানুষের মনে বদল আনতে পারবে না৷ এগিয়ে আসতে হবে পরিবারের লোকজনেদেরও৷''
এই শহরের বাসিন্দাদের অনেকেই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমস্যা বুঝতে পারেন৷ প্রাচী সিনেমা হলে ‘নগরকীর্তন' ছবির দর্শক রূপালী সরকার ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘সত্যি বলতে তো এসব কিছুই জানতাম না৷ সিনেমার মাধ্যমে বুঝতে পারছি আসলে এঁরাও রক্তমাংসের মানুষদের মতো৷ এঁদেরও দুঃখ, শোক, ভালোবাসা আছে৷ এই ধরনের ছবি আরো তৈরি করলে আমরা অনেক কিছু জানতে পারব৷''
জানতে পারবেন রূপান্তরকামীদের আত্মীয়-পরিজনরাও৷ ৯-১০ বছর যাবৎ রূপান্তরকামী উৎসবের নিজের পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই৷ অপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায় এখন উৎসবকে শুধু একটিবারের জন্য চোখের দেখা দেখতে চান৷ তিনি উৎসবের এই নতুন সত্তাকে মেনে নিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘সত্যি সমাজ কিছুটা হলেও পালটেছে৷ আমি তখন সেভাবে ভাবতে পারিনি৷ কারণ, আমি বুঝতে পারিনি ছেলের চিন্তাভাবনা৷ আমি যদি জানতে পারতাম, অন্যভাবে ভাবতাম বৈকি! এই সচেতনতার জন্যই এমন চলচ্চিত্রের দরকার, বাবা-মায়েরা যাতে সন্তানের অবস্থাটা বুঝতে পারেন৷''