দক্ষিণ আফ্রিকার ‘বর্ন ফ্রি’ প্রজন্ম
১০ মে ২০১৪দক্ষিণ আফ্রিকার অধিবাসীদের এক চতুর্থাংশ ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি তরুণ৷ অন্যান্য দেশের তরুণদের সঙ্গে তাদের বেশ পার্থক্য রয়েছে৷ তারা ‘বর্ন ফ্রি' প্রজন্ম৷ ১৯৯০-এ দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রনায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা সগর্বে হাত উঁচু করে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন৷ ভেঙে পড়ে জাতিভেদ প্রথা৷ অন্য এক দক্ষিণ আফ্রিকার সৃষ্টি হয়৷ এই মুক্ত সমাজে জন্ম হয় নতুন প্রজন্মের৷
নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে
‘‘আমরা মুক্ত দেশে জন্ম গ্রহণ করেছি৷ আমরা কী করবো না করবো, তা নিজেরাই ঠিক করতে পারি৷'' বলেন ২০ বছর বয়সি কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী টিফানি সিমা৷ কানে তার সোনালি দুল, মাথায় লম্বা বেণি৷ জোহানেসবুর্গ ইউনিভার্সিটিতে পরিবেশ ব্যবস্থাপনা নিয়ে পড়াশোনা করছেন তিনি৷ জোহানেসবার্গের শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকা থেকে এসেছেন তিনি৷ মা পরিচারিকা থেকে ম্যানেজার হয়েছেন৷ টিফানির কাছে অনুকরণীয় এক দৃষ্টান্ত৷ মা শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে ভাল কিছু করার উপদেশ দিয়েছেন মেয়েকে৷ বড় চার ভাই টিফানির শিক্ষার ব্যাপারে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন৷
২০ বছর আগে অ্যাপার্থাইড বা জাতিভেদের সময় কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের সমানাধিকার বা সমান সুযোগ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না৷ ‘‘আমাদের অনেক কিছু পুনরুদ্ধার করতে হবে৷ এখনও মানুষরা বর্ণ, ভাষা ও বংশের কারণে দমনের শিকার হচ্ছেন৷ এটা অবশ্য ভাল শোনায় না যে, আমার বন্ধুবান্ধবরা সবাই কালো বর্ণের৷'' বলেন টিফানি৷
সবার সমানাধিকার
আইনত সব নাগরিকেরই সমান সুযোগের অধিকার রয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে সাদা ও কালো মানুষের জীবনযাত্রায় বেশ পার্থক্য দেখা যায়৷ আজ এটা হলো অর্থ, যা দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষদের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করছে৷ আলেক্সান্ড্রা নাশ ও মেগান টমাস স্কুল জীবন থেকেই বন্ধু৷ তাদের অনেক কিছুই আছে৷ ‘‘আমরা শ্বেতাঙ্গ মধ্যবিত্ত কিংবা বলা যায় উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি৷'' মেগান কেপ টাউনে মিডিয়া নিয়ে পড়ছেন৷ আলেক্স স্কটল্যান্ডে মেডিকেল পড়ছেন৷
আইস-ক্যাফেতে বসে বেসরকারি স্কুল কলেজ, বিরাট বাগান, ইউরোপে ছুটি কাটানো এসব বিষয় নিয়ে গল্পগুজব করেন তাঁরা৷ আসলে তাঁরা মা-বাবার মতোই একই ধরনের পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছেন৷ শুধু বর্ণবাদ ছাড়া , যা দুজনই প্রত্যাখ্যান করেন৷
‘‘যা ঘটে গিয়েছে তাতে আমাদের হাত নেই৷ কিন্তু এখন আমাদের সামাজিক অসাম্য দূর করার ব্যাপারে দায়িত্ব রয়েছে৷'' বলেন আলেক্সান্ড্রা৷ এই দুই বান্ধবী দরিদ্রদের জন্য কাজ করেন৷ তারা রাজনীতি সচেতন৷ নিজেদের দেশের পরিস্থিতির পরিবর্তনের ব্যাপারে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন৷ তবে এখানেও শ্রেণি বৈষম্য রয়েছে৷ ‘‘কৃষ্ণাঙ্গ বা শ্বেতাঙ্গ যাই হোক না কেন, আমার সব বন্ধু বান্ধবের আগ্রহ একই ধরনের৷ আমরা ছুটি কাটাতে যাই প্রায় একই রকম জায়গায়৷ এই দেশে ইন্টিগ্রেশন সফল, তবে তা একটি শ্রেণিতে সীমাবদ্ধ৷'' জানান আলেক্সান্ড্রা৷
ওপরে ওঠার সুযোগ রয়েছে সবার
জেফরি মুলাউডসি যে সমাজে চলাফেরা করেন, সেখানে সবাই দরিদ্র ও কালো৷ জোহানেসবার্গের সবচেয়ে পুরানো টাউনশিপ আলেক্সান্ড্রায় বাস করেন এই তরুণ৷ ধনীদের পাড়া সান্ডটোন থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে৷ কয়েক হাজার মানুষ ঘেঁষাঘেঁষি করে বসবাস করেন এখানে৷
তবে ২১ বছর বয়সি জেফরি এর মধ্যেই নিজস্ব এক জগত গড়ে তুলেছেন৷ পর্যটকদের জন্য সাইকেল-ট্রিপের ব্যবস্থা করেছেন ৷ এছাড়া তরুণ ব্যবসায়ীদের একটি মেন্টরিং-প্রোগ্রামে যুক্ত তিনি৷ এজন্য মাঝে মাঝে স্যুটও পরতে হয় তাঁকে৷
‘‘আমি কখনও গায়ের রং বদলাতে পারবো না৷ কিন্তু বিত্তশালী হওয়াটা অসম্ভব নয়৷ আমার মায়ের এক সেন্টও অতিরিক্ত ছিল না৷ আর আজ আমি স্কুলের ছাত্রদের জন্য জুতাও কিনে দিতে পারি৷ '' বলেন জেফরি৷ দক্ষিণ আফ্রিকায় এখনও বৈষম্য রয়েছে৷ এতো শিগগির এটা শেষ হবে না৷ তবে এতে রাগ করে লাভ নেই৷ ইতিবাচক চিন্তা করতে শিখেছে ‘বর্ন ফ্রি' প্রজন্ম৷ এই প্রজন্মের দুই তৃতীয়াংশ বেকার, সুপ্রশিক্ষণও নেই৷ কিন্তু ‘বর্ন ফ্রি' প্রজন্ম আত্মপ্রত্যয়ী৷ কঠোর পরিশ্রম করলে লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে এবং অ্যাপার্থাইডকে দূর করতে হলে আরো কিছুটা সময় প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা৷
গণতন্ত্র সম্ভাবনা বয়ে এনেছে
গণতন্ত্র তাদের প্রজন্মের জন্য অনেক সম্ভাবনা বয়ে এনেছে৷ এ ব্যাপারে সাদা বা কালো, ধনী বা দরিদ্র সকলেই একমত৷ মুক্তি সংগ্রামের ব্যাপারে তাদের সরাসরি অভিজ্ঞতা নেই৷ রাজনীতিবিদরাই এখন তাদের ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারক৷ কিন্তু এক্ষেত্রে তারা যা দেখছেন, তা তাদের ক্ষুব্ধ করে তোলে৷ প্রতিদিন অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতি সংক্রান্ত খবরাখবর শিরোনাম হয়ে ওঠে৷
ঐক্যবদ্ধ ও সফল ‘রেনবো' জাতি হিসাবে গড়ে ওঠার স্বপ্নটা ধূলিসাৎ হতে দিতে চান না তারা৷ কেননা ‘বর্ন ফ্রি' প্রজন্ম অন্য যে কোনো জায়গার চেয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাতেই বসবাস করতে পছন্দ করে৷