দারিদ্র্য ঢাকতে দেওয়াল
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০হীরক রাজার দেশের ওই দৃশ্যটির কথা মনে আছে? বর্ষপূর্তির উৎসবে গরিব মানুষদের চেহারা, হতদরিদ্র দশা যাতে বিদেশি অতিথিদের চোখে না পড়ে সে জন্য বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হল৷ সুদৃশ্য রঙিন কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হল চারপাশ৷ অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের আসন্ন সফর উপলক্ষে গরিবি ঢাকার প্রায় সেরকমই চেষ্টা হচ্ছে আহমেদাবাদে৷ সেখানে অবশ্য কাউকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়নি। শুধু মোদী-ট্রাম্প যে রাস্তায় রোড শো করবেন, সেখানে গরিবি ঢাকতে রাস্তার পাশে আধ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছয় ফুট লম্বা দেওয়াল বানানো হচ্ছে৷ আর তা নিয়ে শুরু হয়েছে প্রবল বিতর্ক৷ প্রশ্ন উঠেছে, এ ভাবে কি গরিবি ঢাকা যায়? গরিবি যদি বাস্তবতা হয় তা হলে কি ঢাকা উচিত? আজকাল কোন তথ্য আর কার কাছে অজানা থাকে?
আহমেদাবাদ প্রশাসনের যুক্তি, তাঁরা কোনও কিছু লুকোচ্ছে না, ঢাকছে না, দেওয়াল তৈরির সিদ্ধান্ত অনেক আগে নেওয়া হয়েছে, তখন ট্রাম্পের সফর চূড়ান্ত হয়নি৷ আহমেদাবাদ পুরসভার কমিশনার বিজয় নেহরার দাবি, ''সরকারি জমি যাতে বেদখল না হয়, তার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ এর সঙ্গে ট্রাম্পের সফরের কোনও সম্পর্ক নেই৷ আমি কিছুদিন আগে ওই এলাকা পরিদর্শন করি৷ তখন বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে দেওয়াল বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ জমি দখল আটকাতে ও গাছ বাঁচাতে এটা জরুরি ছিল৷ বিমানবন্দর থেকে সর্দার বল্লভভাই স্টেডিয়াম পর্যন্ত রাস্তায় রোড শোর দিন কুকুর, বেড়াল বা অন্য পশু যাতে না আসে, সেটাও নিশ্চিত করবে পুরসভা৷''
এই স্টেডিয়ামেই হবে, 'কেম ছো ট্রাম্প'(কেমন আছেন ট্রাম্প) অনুষ্ঠান৷ অ্যামেরিকায় হাউডি মোদীর অনুকরণে এই অনুষ্ঠান হবে৷ ট্রাম্পের ভারত সফরের ঘোষণা করে হোয়াইট হাউস জানিয়েছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, লক্ষ লক্ষ লোক থাকবেন রাস্তার ধারে। পুরো রোড শো তে ৫০ থেকে ৭০ লক্ষ লোক হতে পারে৷
আর তার জন্য সৌন্দর্যায়নের ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে পুরসভা৷ বড় বড় সুদৃশ্য গাছ লাগানো হচ্ছে। এমনকী, মেট্রো রেলের অসমাপ্ত পিলার বা অন্য জায়গায় সুন্দর করে রঙ দেওয়া হচ্ছে৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, দেওয়ালও বানানো হচ্ছে ওই লক্ষ্যেই।
আহমেদাবাদে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান প্রীতি দাস৷ তিনি শুধু অধ্যাপকই নন স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান এবং মানবাধিকার কর্মী। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''গুজরাটে এটা নতুন কিছু নয়। এর আগে শি জিনপিং যখন এসেছিলেন, ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী যখন এসেছিলেন, তখনও গরিবি ঢাকতে বড় বড় সুদৃশ্য রঙিন কাপড় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ এ বার আরও এক ধাপ এগিয়ে একবারে দেওয়ালই তুলে দেওয়া হচ্ছে৷ মেক্সিকো সীমান্তে ট্রাম্প দেওয়াল তোলার আগে নরেন্দ্র মোদীর গুজরাটে দেওয়াল উঠে গেল৷'' এ ভাবে গরিবি ঢাকার চেষ্টা নিয়ে কোনও আলোড়ন ওঠে না? প্রীতির জবাব, ''ঘটনা হল, যখন তখন বিভিন্ন জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করে দেওয়া হয়৷ তখন প্রতিবাদ করতে গেলেই গ্রেফতার করা হয়৷ গুজরাটে যে ভাবে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়, তা সম্ভবত অন্যত্র হয় না৷'' সম্প্রতি কাশ্মীর নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, ব্রিটিশ আমলের মতো দীর্ঘদিন ও যখন তখন ১৪৪ ধারা জারি করা বাঞ্ছনীয় নয়৷
আহমেদাবাদে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছেন রথীন দাস৷ তিনিও ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''বিদেশি প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টদের সফরের সময় তো বটেই, ভাইব্রেন্ট গুজরাট অনুষ্ঠান হলেই গরিব এলাকা ঢাকতে রঙিন কাপড় লাগানো হয়৷ এ বারের নতুনত্ব, দেওয়াল৷ একেবারে পাকাপাকি বন্দোবস্ত৷ কিন্তু এ ভাবে কি গরিবি ঢাকা যায়? বিশেষ করে সামাজিক মিডিয়ার রমরমার দিনে? যায় না৷ আর যেটা বাস্তব, সেটা ঢাকার চেষ্টা করেই বা লাভ কি?'' বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, কথায় কথায় নরেন্দ্র মোদী ডিজিটাল ইন্ডিয়ার কথা বলেন, সামাজিক উন্নয়নের কথা বলেন। অথচ তাঁর গুজরাটে গরিবির চেহারা দেওয়াল দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। এর চেয়ে নির্মম বিষয় আর কিছু হতে পারে না।
জিএইচ/এসজি(দ্য হিন্দু, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)