দার্জিলিং নিয়ে অশান্তি
৫ আগস্ট ২০১৩এক সময় রসিকতা করে বলা হতো, বাঙালির দী-পু-দা৷ অর্থাৎ পর্যটনপ্রিয় বাঙালির সেরা পছন্দের তিন গন্তব্য – দীঘা, পুরী আর দার্জিলিং৷ কিন্তু যাঁরা পাহাড় ভালোবাসেন, তাঁরা দার্জিলিং ছাড়াও প্রতিবেশী সিকিম বা ওদিকে হিমাচল বা উত্তরাখণ্ড বেছে নেন বেড়াতে যাওয়ার জন্যে৷ এর মধ্যে উত্তরাখণ্ড বেশ কিছু বছর ধরেই বাঙালি পর্যটকের পছন্দের তালিকার শীর্ষে ছিল৷ নিছক প্রাকৃতিক নিসর্গ উপভোগকারী থেকে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্বতারোহী, পুণ্যার্থী মানুষ থেকে আরামপ্রিয় বিত্তবান পর্যটক, সবাইকে খুশি করত উত্তরাখণ্ড৷ কিন্তু সাম্প্রতিক যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে গেল সেখানে, তার পর ওখানকার ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট মেরামত করতে এবং ক্ষতিগ্রস্থ পরিকাঠামো ফের গড়ে তুলতে এখন অন্তত বছর দুয়েক সময় লাগবে বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর৷
এই পরিস্থিতিতে এবার দার্জিলিং এবং সিকিমের পাহাড়ি গন্তব্যগুলোতে যাওয়ার ঝোঁক বেড়েছিল৷ অক্টোবরে দূর্গাপুজোর ছুটির মরশুমে বহু বাঙালি পর্যটক এবার হলিডে প্যাকেজ বুক করেছিলেন, জানালেন এক পর্যটন সংস্থার কর্নধার রাজা দেব৷ দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গ এবং সিকিমের পাহাড়ে পর্যটক নিয়ে যাচ্ছেন রাজা৷ তাঁর ব্যবসার মূল ক্ষেত্রই হল ওই অঞ্চল৷ মাঝে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের জন্য রাজার ব্যবসার ব্যাপক ক্ষতি হয়৷ কিন্তু এই বছর শুরু থেকেই এত বেশি বুকিং হয়েছিল যে বেশ খুশিই ছিলেন রাজা৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্যের দাবি মেনে নেওয়ায় উৎসাহিত হয়ে আবারও পাহাড়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন বিমল গুরুং৷ তাতে চিন্তার ভাঁজ পর্যটকদের কপালে এবং অনেকেই এর মধ্যে ফোন করে বলে রেখেছেন, পরিস্থিতি বুঝলে তাঁরা কিন্তু বুকিং বাতিল করবেন, জানালেন রাজা৷
মাত্র কিছুদিন আগে দার্জিলিংয়ের এক বিলাসবহুল হোটেলে তিন রাতের জন্য ঘর বুক করেছেন কলকাতার ব্যস্ত অ্যানাস্থেটিস্ট ড. নির্মল হালদার৷ তিনি জানালেন, তিন রাত যা ঘরভাড়া হয়, তার পুরো পয়সা আগাম নিয়ে নিয়েছে হোটেলটি, যেহেতু তিনি যাবেন একেবারে ছুটির মরশুমের একেবারে সেরা সময়ে, দূর্গাপুজোর তিন দিন৷ একমাত্র ওই সময়েই ব্যস্ততার থেকে তাঁর রেহাই৷ কিন্তু যদি কোনো এমার্জেন্সি অপারেশনের ডাক আসে, সেকথা ভেবে সপরিবারে ছুটি কাটানোর জন্য ঘরের কাছের দার্জিলিংকেই বেছে নিয়েছিলেন৷ তাদের প্লেনের টিকিটও আগেই কাটা হয়ে গিয়েছে৷ কিন্তু এখন বিমল গুরুঙের আন্দোলনের ডাকে প্রমাদ গুনছেন ডঃ হালদার৷
ওই পর্যটন সংস্থার মালিক রাজা জানাচ্ছেন, শুধু দার্জিলিং নয়, উত্তরবঙ্গের অনেক ছোট ছোট অনামি জায়গায় খুব ভালো পর্যটন কাঠামো গড়ে উঠেছে বাঙালি পর্যটকদের সুবাদে৷ দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং – এই ট্রায়োকে বাদ দিয়েও রাভাংলা, সিলেরি গাঁও বা সিকিমের রিনচেনপং-এর মতো জায়গা পর্যটক গন্তব্য হিসেবে দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে৷ বড় হোটেল-মালিকরা নন, স্থানীয় মানুষ এই সব জায়গায় হোম স্টে-র ব্যবস্থা করে পর্যটক মরশুমে ভালো রোজগার করতে পারছেন৷ ফলে সামগ্রিকভাবে গোটা এলাকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হচ্ছে৷ বিমল গুরুঙের আন্দোলন এই মানুষদের কী উপকার করছে, তা তিনি জানেন না, বিরক্ত মুখে মন্তব্য করলেন রাজা দেব৷
যদিও দীর্ঘদিন পাহাড়ের রাজনীতির ধরনধারণ দেখে অভ্যস্ত, শিলিগুড়ির এক সাংবাদিক জোর দিয়ে বলছেন, পর্যটনের মরশুমে পাহাড়ে কোনো অশান্তি হবে না৷ এই আগস্ট মাসে বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ে এমনিতেই কেউ যায় না, তাই বিমল গুরুং নিশ্চিন্তে এই ৭২ ঘণ্টার বনধ-কে বাড়িয়ে ৯৬ ঘণ্টার করে ফেলতে পারছেন৷ কিন্তু পুজোর ছুটির সময় সেটা হবে না৷
তবে বনধ ডাকার পর বিমল গুরুং যেভাবে দার্জিলিং, কার্শিয়াংয়ের স্কুলগুলোকে খালি করে ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি চলে যেতে বলেছেন, তাতে দার্জিলিংয়ের তরুণ প্রজন্ম খুবই ক্ষুব্ধ৷ ফেসবুকে দার্জিলিংয়ের প্রবাসী মানুষজনের একটা কমিউনিটি আছে, সেখানে এক সদস্য চমৎকার মন্তব্য করেছেন যে, দার্জিলিংয়ের লোকেদের পৃথক গোর্খাল্যান্ড দরকার, অবশ্যই দরকার৷ কিন্তু তার আগে দরকার কিছু যোগ্য নেতা, যাঁরা যথার্থ নেতৃত্ব দিতে পারবেন৷ এমন নেতা, যাঁরা বিধানসভায় বা লোকসভায় গিয়ে আলাদা গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠনের পক্ষে এমন জোরদার সওয়াল করবেন যে কারও বিরোধিতা করার হিম্মত থাকবে না৷ কিন্তু এমন নেতা দরকার, যাঁরা কথায় কথায় বনধ ডেকে জনজীবন বিপর্যস্ত করবেন না, লোকের উপার্জন বন্ধ করবেন না, বা জোর করে স্কুল বন্ধ করে দার্জিলিংয়ের ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেন না৷