বাংলাদেশের প্রথম সারির দু'টি পত্রিকার শিরোনাম দিয়েই লেখা শুরু করি৷ একটি পত্রিকার শিরোনাম, ‘‘জাপানি নারীর দুই মেয়েকে উদ্ধার''৷ অন্যটি লিখেছে, ‘‘জাপানি নারীর দুই মেয়েকে উদ্ধার করেছে সিআইডি''৷
কোনো ইস্যুতে মানুষের নিজস্ব মতামত তৈরি করতে গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে৷ শিরোনামগুলো আমার বিবেচনায় ঘটনার সঙ্গে মানানসই হয়নি৷ কারণ, ১০ ও ১১ বছর বয়সি সন্তান দু'টি শুধু জাপানি নারীর একার নয়, বাঙালি বাবারও৷ আমরা সবক্ষেত্রে যখন নারী-পুরুষ সমতার কথা বলি, তখন কেন এই সন্তান দু'টিকে এককভাবে শুধু মায়ের বলছি সেটা আমার কাছে বোধগম্য নয়৷ তাছাড়া এই শিরোনাম এবং প্রতিবেদনের ভাষা এমন যে মনে হবে বাবা তার দুই সন্তানকে বাংলাদেশে এনে বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছেন৷ দু'টো সংবাদের একটিতেও বাঙালি বাবা বা তার আইনজীবীর বক্তব্য নেয়া হয়নি৷
বাবা কোনো অপরাধ করেছেন কিনা সেটা নিশ্চয়ই আদালত নির্ধারণ করবেন৷ আমার কথা হচ্ছে, কারো অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে যেন অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা না হয়৷ কেননা, এটা করা হলে সেই ব্যক্তির সামাজিক, মানসিক এবং আর্থিক ক্ষতি হতে পারে, যেটা পরবর্তীতে তিনি নিরপরাধ প্রমাণিত হলেও অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবেই রয়ে যাবে৷
জাপান একটি উন্নত দেশ৷ এমন দেশ থেকে একজন বাবা কীভাবে একা একাই তার দুই সন্তানকে বেশ কয়েকদিন নিজের কাছে রেখে তাদের জন্য পাসপোর্ট (ঢাকার পত্রিকায় এই পাসপোর্ট জাপানি নাকি বাংলাদেশি উল্লেখ নেই, তবে যে দ্রুত সময়ে পাসপোর্ট পাওয়া গেছে তাতে এটা জাপানি বলে ধরে নেয়া যায়) তৈরি করে, তাদের নিয়ে বৈধভাবে জাপানি বিমানবন্দর পার হয়ে বাংলাদেশে এলেন সেটা নিয়ে একটু জানার আগ্রহ হলো৷ একজন জাপানি মা কেন জাপানে থাকাকালেই তার সন্তানদের জাপানি আইনের সহায়তা নিয়ে নিজের কাছে নিতে পারলেন না, সেটাও এক প্রশ্ন আমার কাছে৷
এই দুই প্রশ্নের উত্তর জাপানি আইনেই আছে৷ ইন্টারনেটে পাওয়া সেই আইনের সারাংশ থেকে দু'টি বিষয় জেনেছি৷
০১. বাবামায়ের কোন একজন যদি তাদের সন্তানকে জোর করে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখে সেটা জাপানে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে৷ এক্ষেত্রে অন্য অভিভাবকের দায়িত্ব হচ্ছে একজন আইনজীবীর মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা করা ও জাপানি পুলিশকে বিষয়টি দ্রুত জানানো৷ তবে, জাপানি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পারিবারিক বিষয়াদি ‘ব্যক্তিগত বিষয়' হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাতে হস্তক্ষেপ করতে তেমন একটা উৎসাহী হয় না৷
০২. সন্তানের যেকোনো একজন অভিভাবক চাইলে যেকোনো সময় তার সন্তানকে নিয়ে জাপানের বাইরে যেতে পারেন৷ সন্তান যার কাছে আছে তার যদি সেই সন্তানকে রাখার আইনি অধিকার না থাকে, কিন্তু সন্তান যদি তার কাছে থাকে তাহলে তিনি সেই সন্তানকে নিয়ে জাপানের বাইরে যেতে পারেন৷ একটি শিশুকে জাপানের বাইরে না নেয়ার নিষেধাজ্ঞা জাপানি আদালত দিতে পারে না৷
জাপানি আইন অনুযায়ী, একটি দম্পতির বিচ্ছেদের পর তাদের সন্তানদের দায়িত্ব যেকোনো একজন পাবেন৷ সেটা বাবাও হতে পারেন, মাও হতে পারেন৷ ‘জয়েন্ট কাস্টাডি' অর্থাৎ সন্তান যেকোনো এক জায়গায় মূলত থাকলেও বাবা এবং মা উভয়ের তাদের উপর আইনি অধিকার থাকার যে বিধান জার্মানিতে রয়েছে, জাপানে সেটা নেই৷ শুধু তাই নয়, এই বিষয়ে জাপানের বাইরের কোনো দেশের আদালত কোনো রায় দিলে, সেই রায় জাপানের আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না৷ তবে, বিচারক চাইলে বিষয়টি আমলে নিতে পারেন৷
এখানে আরো একটি বিষয় বলা প্রয়োজন মনে করছি৷ একজন জাপানি মা দীর্ঘ চেষ্টা করে তার সন্তানদের দেখা পেতে বাংলাদেশে এসেছেন৷ শিশু দু'টিকে নিয়ে মায়ের মনে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক এবং তাদের সঙ্গে তাকে মুক্তভাবে মেশার সুযোগ দেয়া উচিত ছিল৷ একজন সুস্থ মা বা বাবাকে সন্তানদের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করা কোনোভাবেই উচিত নয়৷ বাঙালি বাবা কেন জাপানি মা ঢাকা আসার পরও আপাতদৃষ্টিতে সেই সুযোগ দিলেন না এবং এই নারীকে কঠিন সংগ্রামে ফেলে দিলেন সেটা আমার বোধগম্য নয়৷ তিনি বিষয়টি আদালতের বাইরে সুরাহার উদ্যোগ নিতে পারতেন৷
শিরোনামে অতি উৎসাহী পুলিশ অংশটার ব্যাখ্যা দেই এবার৷ জাপানি মা তার সন্তানদের কাছে পেতে বাংলাদেশে আইনি লড়াইয়ের উদ্যোগ নিয়েছেন৷ এটা করার অধিকার পুরোপুরি তার রয়েছে৷ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ৷ সন্তান দু'টি সেদেশে থাকাকালে তাদের ভবিষ্যত কী হবে সেটাও নিশ্চয়ই বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী নির্ধারিত হবে৷
ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, জাপানি মা বৃহস্পতিবার ঢাকার হাইকোর্টে সন্তানদের অভিভাবকত্ব পেতে ও তাদের আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেন৷ রিটটি আমলে নিয়ে শিশু দু’টির বাবা ও তার বোনকে ৩১ আগস্ট তাদের নিয়ে হাজির হতে বলেছেন আদালত৷
বাঙালি বাবা যাতে শিশু দু'টিকে নিয়ে এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে না পারেন তাও নিশ্চিত করতে বলেছেন আদালত৷
কিন্তু, ঢাকার পুলিশ ৩১ আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি নয়৷ তার আগেই তারা শিশু দু'টিকে বাঙালি বাবার কাছ থেকে ‘উদ্ধার করেছে'৷ আমার কাছে মনে হয়েছে পুলিশ অতি উৎসাহী হয়ে কাজটি করেছে৷ আর এক্ষেত্রে শিশুদের মনস্তাত্বিক দিকটা বিবেচনা করা হয়নি৷
বাবামায়ের বিচ্ছেদ এমনিতেই সন্তানদের উপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে৷ তারপরও নানা কারণে বিচ্ছেদ হয় এবং সেটা মানুষের স্বাধীনতার বিষয়৷ কিন্তু বিচ্ছেদের শিকার দু'টি সন্তান বাবা বা মায়ের চেয়ে পুলিশের কাছে বেশি নিরাপদ হতে পারে না৷ বিশেষ করে বাংলাদেশে যেভাবে পুলিশি অভিযান চালানো হয় তা যেকারো জন্যই ভীতিকর৷ ফলে তাদের বাবার সঙ্গে আদালতে হাজিরের সুযোগ না দিয়ে এভাবে উদ্ধার করে আরো ভীতসন্ত্রস্ত করে দেয়া হয়েছে বলে আমি মনে করি৷
শিশু দু'টির ভবিষ্যতে কার কাছ থাকবে সেটা নিশ্চয়ই ঢাকার আদালতে কিছুটা নির্ধারিত হবে৷ পরবর্তীতে জাপানের আদালতেও বিষয়টি গড়াতে পারে৷ তবে, গণমাধ্যমের উচিত হবে এককভাবে কোনো একটি পক্ষকে এক্ষেত্রে দোষী করার চেষ্টা না করা৷ বিষয়টি আইনিভাবেই নির্ধারিত হোক৷ একজন সন্তানকে তার মা যেমন ভালোবাসেন, তার বাবাও একইভাবে ভালোবাসেন৷ ব্যতিক্রম থাকতে পারে, সেটাও উভয়ক্ষেত্রেই থাকে৷