দুর্নীতি গেছে কত দূর?
১১ জুলাই ২০২৪এদের কেউ এখনো চাকরিতে আছেন৷ আবার কেউ অবসরে৷ প্রশ্ন হচ্ছে, যা প্রকাশ পাচ্ছে তাই কি সব, না আরো অনেক গভীরে দুর্নীতি?
বিশ্লেষকcরা মনে করছেন, যা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে তা দেশে বিশাল দুর্নীতির হিমশৈলের সামান্য অংশ মাত্র৷ তারা বলছেন, সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো এখন যাদের দুর্নীতির খবর প্রকাশ হচ্ছে তারা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থেকে দুর্নীতি করছেন৷ ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই এই দুর্নীতি তাদের অধস্তন পর্যায়ে সঞ্চারিত হয়েছে৷ তারা ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এই দুর্নীতি করেছেন৷ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সবাই যেমন দুর্নীতিবাজ না, তেমনি অনেকেই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পরেছেন৷ ফলে এখন একটি দুর্নীতি সমাজের চিত্র যাচ্ছে৷ আর এটা আরো অনেক বিস্তৃত৷
সম্প্রতি পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশের পর একে একে অনেকের দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসছে৷ বেনজীরের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমান, প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল, পুলিশের আরো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাসহ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার দুর্নীতির খবর প্রকাশ হয়েছে৷ সর্বশেষ আলোচনায় আছে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) কর্মকর্তাদের বিসিএসসহ সরকারি চাকরির প্রশ্ন ফাঁস করে কোটি কোটি টাকা আয়ের খবর৷
দুর্নীতি কত গভীরে?
সংবাদ মাধ্যমগুলো গত দুই মাস ধরে প্রতিদিনই সরকারের কোনো না কোনো কর্মকর্তার দুর্নীতির খবর দিচ্ছে৷ আর এখন দুদক কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে৷ তবে তারা প্রকাশিত খবরের ওপর নির্ভর করেই দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে৷ এই দুর্নীতির শেকড় আরো কত বিস্তৃত এবং গভীর হতে পারে সেই প্রশ্নের জবাবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,‘‘যেগুলো প্রকাশ পাচ্ছে সেগুলো এখন সরকারের পুলিশ, প্রশাসন, এনবিআরসহ বিভিন্ন দপ্তরের শীর্ষ পর্যায়ের দুর্নীতি৷ আমাদের পর্যবেক্ষণ এর বিস্তৃতি অনেক বেশি৷ যা প্রকাশ পাচ্ছে তা ঘটে যাওয়া শীর্ষ পর্যায়ের দুর্নীতির সামান্য অংশ৷''
তার কথা, ‘‘বেনজীর আহমেদ পুলিশ কমিশনার, র্যাবের মহাপরিচালক এবং পুলিশের আইজির দায়িত্ব পালন করেছেন৷ তিনি প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসবে দায়িত্ব পালনের সময় তার এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে দুর্নীতি করেছেন৷ তার মানে হলো তিনি তার অধীনস্তদের এই দুর্নীতির কাজে ব্যবহার করেছেন৷ ফলে তাদের একটি অংশও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন৷ আবার তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রটেকশনও পেয়েছেন৷ ফলে তার দুর্নীতি ছিলো আগ্রাসী এবং সর্বব্যপী৷ আবার এনবিআরের মতিউর রহমানও শীর্ষ পর্যায় থেকে দুর্নীতি করেছেন৷ এটা ভাবার কোনো কারণ নাই যে তিনি একা এই কাজ করেছেন৷ তার সঙ্গে আরো অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত৷''
তার কথা, ‘‘এনবিআরের মতিউর সাহেব যে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন এই একটি মামলার সঠিক তদন্ত করলেই দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার বোঝা যাবে৷ সাধারণভাবেই বোঝা যায় যে তিনি কর ফাঁকির অবৈধ সুযোগ দিয়ে দুর্নীতি করেছেন৷ এটা তার একার পক্ষে করা সম্ভব হয়নি৷ তার সঙ্গে আরো অনেকে আছেন৷ তারপর তিনি কত টাকার বিনিময়ে কত কর ছাড়ের অবৈধ সুবিধা দিয়েছেন৷ সেটা তার দুর্নীতির অর্থের চেয়ে বহুগুণ বেশি হবে৷ তাহলে রাষ্ট্র কত টাকার কর থেকে বঞ্চিত হয়েছে৷ আবার কারা এই কর ফাঁকি দিয়েছেন৷ এই সব মিলিয়ে যদি চেইনটি চিন্তা করেন তাহলে এটা যে কতদূর বিস্তৃত তা বোঝা সম্ভব হবে৷''
‘‘আসলে সরকারের এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নাই যে যেখানে এখন শীর্ষ পর্যায়ে দুর্নীতি নাই৷ আর এই দুর্নীতিগ্রস্তরা পদের কারণে যেমন ক্ষমতাবান, তেমনি তাদের রাজনৈতিকভাবে সহায়তা দেয়া হয়৷ সংসদে বেনজীর, মতিউরদের দুর্নীতির প্রতিবাদেও চেয়ে তাদের পক্ষে সাফাই বেশি হয়েছে৷ আর কালো টাকা সাদার করার সুযোগ দিয়ে এই দুর্নীতিকে সহায়তা করা হচ্ছে৷ বলা হচ্ছে তুমি দুর্নীতি করো সমস্যা নাই৷ পরে ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করে নেবে,'' বলেন তিনি৷
পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘‘একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানে পেশাদারত্ব ইন্টিগ্রিটি কিছুই থাকে না৷ আর তা আমরা তো এখন দেখতেই পাচ্ছি৷ সরকারের সব প্রতিষ্ঠানেই এখন দুর্নীতি৷''
তিনি বলেন, ‘‘সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কোনো ইউনিটের প্রধান হিসাবে যখন কাউকে দায়িত্ব দেয়া হয় তখন সরকার তার ব্যাপারে গোয়েন্দা রিপোর্ট দেখে৷ এখন আমার প্রশ্ন হলো এইসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ব্যাপারে গোয়েন্দারা কী রিপোর্ট দিয়েছিলেন? তারা কি সঠিক রিপোর্ট দিয়েছিলেন, না সরকার তার নিজের প্রয়োজনে যাকে মনে করেছে তাকে বসিয়েছে৷
প্রতিষ্ঠানের প্রধান ভালো হলে প্রতিষ্ঠান ভালো হয়৷ যেমন পুলিশের পিবিআই সুনাম কুড়াচ্ছে কারণ ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান দক্ষ এবং পেশাদার৷ অন্য ইউনিটের ব্যাপারে তো শুনিনা৷ আসলে এইভাবে সরকারের সব প্রতিষ্ঠানই এখন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে৷ সরকার তার দলীয় প্রয়োজনে তাদের ব্যবহার করছে আর তারা নিজেদের প্রয়োজনে দুর্নীতি করছে৷ একে অপরকে সহায়তা করছে৷ জনগণ বা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কাউকে কোনো পদে দেয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না''
তার কথা, ‘‘যারা চুরি করতে করতে প্রতিষ্ঠান শেষ করে ফেলেছে তাদের আবার রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার দেয়া হয়৷ যারা দেয় তারা জানে না তাদের দুর্নীতির কথা? তাহলে তাদের পুরস্কার দেয় কীভাবে৷ দুর্নীতিবাজদের যদি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেয়া হয় তাহলে বুঝতে হবে এমন কোনো জায়গা নাই যে দুর্নীতি নাই৷''
এক দুদক কিছুই করতে পারবেনা:
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান দাবি করেন, ‘‘পত্রিকায় দুর্নীতির খবর প্রকাশ হলেও সম্পদের বিস্তারিত হিসাব দুদকই করছি৷ এনবিআরের মতিউরের অবৈধ সম্পদের হিসাব পত্রিকায় যা ছাপা হচ্ছে তা আমরাই বের করেছি৷ আজকেও (বৃহস্পতিবার) একজন পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে৷ দুদক কোনো দুর্নীতিবাজকে ছাড়বেনা৷ আমরা আমাদের অনুসন্ধান বাড়িয়ে দিয়েছি৷''
তবে তিনি জনবলের সংকটের কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘যেভাবে দুর্নীতির তথ্য পাচ্ছি তা এইরকম একটি দুদক দিয়ে ধরা সম্ভব নয়৷ আসলে দুর্নীতি অনেক হয়েছে৷ অনেক বেড়ে গেছে৷ আমাদের আরো লোকবল দরকার৷''
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমরা কোনো চাপে নাই৷ সরকারও চায় দুর্নীতি দমন করতে৷''
তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘‘দুর্নীতির যে বিস্তার হয়েছে তার তদন্ত করতে এরকম ২৫টি দুদক দিয়েও কাজ হবেনা৷ আর দুদকেও তো দুর্নীতিবাজ আছে৷''
‘‘বেনজীরের দুর্নীতির কথা কি সরকার জানতো না? আগে যখন তার দুর্নীতি নিয়ে কথা হয়েছে তখন তো সরকারই তাকে ডিফেন্ড করেছে৷ এনবিআরের সদস্য মতিউরের দুর্নীতি কি এনবিআর চেয়ারম্যান জানতেন না? বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে তো আগেও কথা হয়েছে৷ পিএসসির চেয়ারম্যানরা কী জানতেন না? একজন ড্রাইভার কোটি কোটি টাকা আয় করে প্রশ্ন ফাঁস করে এটা কি অজানা ছিলো? এটা কি তার একার পক্ষে সম্ভব? আসলে দুর্নীতি আগেও ছিলো এখন সবখানে সব পর্যায়ে দুর্নীতি৷ আমরা একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছি,'' বলেন তিনি৷
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয় না শেষ পর্যন্ত এদের কিছু হবে৷ এগুলো লোক দেখানো৷ সরকার চাইলে এদের আগেই ধরতে পারত৷''