দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আসল নায়ক জনগণ
২৭ মে ২০২২করোনাকে যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবে ধরা হয়, তাহলে এটাও মানতে হবে বাংলাদেশ এই দুর্যোগকে বেশ ভালোভাবেই মোকাবেলা করতে পেরেছে৷ কোভিড-১৯-এ আমাদের আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা অনেক উন্নত দেশের চেয়ে কম ছিল৷ বিষয়টা নিয়ে এরই মধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে৷ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগকে দেখা গেছে- করোনা ব্যবস্থাপনার পুরো কৃতিত্ব নিজেদের বলে দাবি করতে৷ স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেও বহুবার এটাকে তাদের সাফল্য হিসাবে বর্ণনা করেছেন৷ কিন্তু বাস্তবতা কি আসলে তাই? সমালোচকরা কিন্তু ভিন্ন কথা বলে৷ তাদের মতে, করোনা মোকাবেলায় সরকারের ভূমিকার চেয়ে সাধারণ মানুষের ভূমিকাই বেশি ছিল৷ সরকার টিকার ব্যবস্থা করেছে- সেটা ঠিক৷ কিন্তু সেই টিকাও তো কেনা হয়েছে তুলনামূলক বাড়তি দাম দিয়ে৷ টিকার বাইরে সরকারের আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা কি ছিল? কোভিড-১৯ এর প্রকোপ যখন বাড়াবাড়ি রকমের ছিল, তখন সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ফ্যাসিলিটি যে পর্যাপ্ত ছিল, সে কথাও বোধকরি বলা যাবে না৷ করোনা নিয়ে মানুষের সচেতনতাও তেমন একটা বেশি ছিল বলে মনে হয় না৷ যখন করোনার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি, তখনও দেশের ৫০ শতাংশ মানুষকে মাস্ক ছাড়া অবাধে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে৷
তাহলে সাফল্যের কৃতিত্বটা ছিলো কার? এটা ছিলো একটা বড় গবেষণার বিষয়৷ দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, প্রয়োজনীয় সেই গবেষণাটি হয়নি৷ কেউ-ই সেটি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি৷ গবেষণা না হওয়ায় নিশ্চিতভাবে হয়তো কারণটি কখনোই জানা যাবে না৷ তবে বিশেষজ্ঞ মহলের একটা ধারণা রয়েছে৷ সেটা হচ্ছে- এই যে করোনা আমাদের এখানে তেমন মারাত্মক কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি- এর মূল কারণ সম্ভবত আমাদের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও এখানকার আবহাওয়া৷ দেখা গেছে, যে সকল মানুষ মাঠে ঘাটে কায়িক শ্রমের সঙ্গে জড়িত, তাদেরকে এই রোগ কাবু করতে পারেনি৷ তুলনামূলকভাবে কম টিকা দেওয়ার পরও গ্রামে বা বস্তিতে কোভিড-১৯ এর তেমন একটা দাপট দেখা যায়নি৷
আর একটি ঘটনার কথা বলি৷ ২০১৭ সালের এপ্রিল মাস৷ সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন হয়েছিল৷ সেখানে সেই সময়ের ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা৷ এই সাংবাদিক সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল- সে সময়ে সুনামগঞ্জে যে বন্যা হয়েছিল, সে বিষয়ে সরকারের পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্তগুলো অবহিত করা৷ সেবার সুনামগঞ্জের এই বন্যা হয়েছিল মারাত্মক, সেই সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী৷ জেলার অধিকাংশ এলাকাই ডুবে গিয়েছিল পানির নিচে৷ মানুষের স্বাভাবিক সকল কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল৷ জলবন্দি মানুষেরা কোনো অর্থনৈতিক কাজকর্মে লিপ্ত হতে পারছিল না৷ জীবন হয়ে পড়েছিল দুর্বিসহ৷ সবমিলিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের দাবি ছিল- বন্যা উপদ্রুত এলাকাটিকে ‘দুর্গত এলাকা' হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হোক৷ এমন পরিস্থিতিতেই যখন ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিতে এলেন, সংবাদকর্মীরা ভেবেছিলেন হয়তো দুর্গত এলাকা ঘোষণা বিষয়ক কোনো বক্তব্য শোনা যাবে৷ কিন্তু বাস্তবে সেখানে ঘটল উল্টো ঘটনা৷ মন্ত্রী কিছু বলার আগেই সচিব জানালেন দুর্গত এলাকা ঘোষণার কোনো বাস্তবতাই সেখানে নেই৷ তিনি বলেন, কোনো এলাকাকে দুর্গত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করতে হলে সেখানে মহামারি দেখা দিতে হবে, সেখানকার অর্ধেক জনসংখ্যাকে মারা যেতে হবে৷ অথচ সুনামগঞ্জে মানুষ দূরে থাক, একটি ছাগলও মারা যায়নি৷ সচিব যখন ছাগল না মারা যাওয়ার তথ্য ও তত্ত্ব দিচ্ছিলেন, মন্ত্রী সাহেব তখন অবশ্য সম্মতিসূচক মাথা নাড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন৷
এই যে কথাগুলো সেদিন ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছিলেন, তার ভিত্তি হিসাবে তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের ২২ নং ধারার কথা উল্লেখ করেছিলেন৷ মজার বিষয় হলো- আইনের ওই ধারায় ‘অর্ধেক জনসংখ্যার মৃত্যু,’ বা ‘মহামারি’- এসব কিছুই নেই৷ তিনি আসলে ২২ নং ধারার নামে মনগড়া আজগুবি কিছু কথা বলেছিলেন৷ এনিয়ে পরে বেশ হইচই হয়েছে৷ আলোচিত সচিবকে আসামী করে সুনামগঞ্জে তখন একটি মামলাও হয়েছিল৷ তবে শেষ পর্যন্ত আর কিছু হয়নি৷ সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা হয়নি, গতানুগতিক ত্রাণ তৎপরতার চেয়ে বেশি কিছু আর দেখা যায়নি৷ আর ওই আজগুবি ধারার জনক সচিবকে বরং কিছুদিন পর পদোন্নতি দিয়ে সিনিয়র সচিব করা হয়েছিল!
এখন কথা হলো, ‘দুর্গত এলাকা’ ঘোষণা করা অথবা না করার মধ্যে পার্থক্যটা কী? খুটিনাটি পার্থক্য হয়তো অনেক, কিন্তু মোটাদাগে একটাই পার্থক্য৷ সেটা হচ্ছে- দুর্গত এলাকায় ত্রাণের পরিমাণটা একটু বেশি হয়৷ বাড়তি এই ত্রাণ কার্যক্রমেই আপত্তি ছিল শীর্ষ আমলার৷ দুর্গত এলাকা ঘোষণা না করায় বন্যা উপদ্রুত সুনামগঞ্জে না খেয়ে কি কেউ মারা গিয়েছিল? না, তা যায়নি৷ সেক্ষেত্রে সচিব সাহেবের সিদ্ধান্তই কি সঠিক ছিল? আসলে মানুষের দুর্ভোগ বা কষ্টের একমাত্র মাপকাঠি ‘মৃত্যু' হতে পারে না৷ কেউ মারা যায়নি বলে, বিপুল সংখ্যক মানুষ সেই সময়ে কষ্ট পায়নি, তা বলা যাবে না৷ হয়তো এমন কষ্টের কথা উন্নত দেশের মানুষেরা চিন্তাও করতে পারবে না৷ কিন্তু আমাদের দেশের মানুষেরা সেই কষ্ট সহ্য করতে পারে৷ তাদের কাছে এই দুর্ভোগ কষ্টকর, কিন্তু অসহ্য নয়৷ বারবার দুর্যোগে পড়ে পড়ে, তারপর সেই সময়ে সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য সহযোগিতা না পেতে পেতে, আমাদের মানুষেরা বুঝে গেছে- তাদেরকে সংগ্রাম করেই বাঁচতে হবে৷ দুর্যোগের সঙ্গে বসবাসে তারা অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে৷
তাহলে কৃতিত্বটা কার? কী করোনার কথা বলি, কী বন্যা বা দৈব দুর্বিপাকের কথা বলি- আমাদের জনগণের সহ্যক্ষমতা অপরিসীম৷ কীভাবে কীভাবে যেন তারা টিকে যায়৷ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ের পথগুলো তারা বের করে ফেলে, নিজেদের মতো করে সেসবকে কাস্টমাইজ করে নেয়, টিকে যায়৷ আর এই যে টিকে যাওয়া, এটাকে পুঁজি করে সাফল্যের দাবিদার হিসাবে আবির্ভূত হয় প্রশাসন বা সরকারে থাকা লোকগুলো৷
দেশে এখন ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক একটা মন্ত্রণালয় আছে৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক একাধিক দফতরও আছে৷ অনেক মাথাভারি লোকজন সেসব জায়গায় বসেন৷ তারা নানা বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন৷ কিন্তু দুর্যোগ প্রতিরোধে তারা এযাবত উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না৷ তারা অঘটন থামাতে পারেন না, অঘটনের জন্য প্রয়োজনীয় পূর্বপ্রস্তুতি বাস্তবায়ন করতে পারেন না৷ পারেন কেবল- সংকট যখন কিছুটা কমতে থাকে তখন অপর্যাপ্ত ত্রাণ নিয়ে সেখানে হাজির হতে৷ আবার সেই ত্রাণ এমন এক বিচিত্র পদ্ধতিতে বিতরণ করা হয় যে, বিতরণের আগেই সিংহভাগ কোথায় যেন চলে যায়৷ সামান্য যতটুকু অবশিষ্ট থাকে, সেটুকুও দেওয়া হয় মুখ চিনে চিনে৷
অতি সম্প্রতিক একটা ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়৷ কদিন আগে হঠাৎ করেই সিলেটে বন্যা দেখা গেল৷ ভারতের চেরাপুঞ্জি, শিলং থেকে বিপুল পানি নেমে এসে ভাসিয়ে দিয়েছে সিলেটকে৷ অনেকেই বলেছেন, উজানে বেশি বৃষ্টি হলে সেটা তো আসবেই৷ এরকম তো আগেও হয়েছে, বহুবছর আগে থেকেই হয়ে আসছে৷ কিন্তু আগের সেই ঢলের সঙ্গে এবারের পার্থক্য কিছু রয়েছে৷ আগে পানি আসত, আবার সুরমা নদী হয়ে সেসব ভাটিতে চলেও যেত৷ এবার আর অত সহজে যাচ্ছে না৷ কারণটা যে খুব অজানা, সেটাও নয়৷ বন্যার এই সময়ে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু দারুন কথা বলেছেন৷ তার মতে, সিলেটে অনেক খাল বিল পুকুর ছিল৷ অপরিকল্পিতভাবে সেসব ভরাট করে ফেলা হয়েছে৷ সুরমা নদীর তলদেশে নানা ময়লা, আবর্জনা, পলিথিন ইত্যাদি জমেছে৷ ফলে এই নদীর ধারনক্ষমতা কমে গেছে৷ এখন একটু পানি হলেই নদীর দুপাড় উপচে পড়ছে৷
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলেটের লোক৷ সারাটা জীবন তাঁর কেটেছে এই শহরে৷ ফলে তাঁর এই পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই৷ এসবই আসলে বাস্তবতা৷ নদীকে নদীর মতো চলতে দেওয়া হচ্ছে না৷ জলাধারগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো- এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলো কেন? কে দায়ি এর জন্য? দায়ি অবশ্যই কিছু লোভী মানুষ, কিছু অসচেতন মানুষ৷ এই মানুষেরা যে অপকর্ম করেছে, তা থামানোর দায়িত্ব কার ছিল? সরকার কি সেই দায়িত্ব পালন করেছে? সমাজে সবসময়ই কিছু লোভী বা দায়িত্বহীন মানুষ থাকেবে৷ কিন্তু তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে তো রাখতে হবে সরকারকেই৷ হতাশার বিষয় হচ্ছে- এই দায়িত্বহীন লোকগুলোই এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কখনো কখনো তারা সরকারের অংশ পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে৷ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নদী, খাল বিল ভরাটের যত ঘটনা আছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে তার প্রত্যেকটির পিছনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে৷
আমাদের এই বাংলাদেশ এমনিতে দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ৷ আন্তর্জাতিক একাধিক প্রতিষ্ঠানের মতে দুর্যোগ বিপন্নতায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়৷ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পৃথিবীতে সংঘটিত দুর্যোগগুলোর ৪৫ শতাংশই হয় এশিয়া মহাদেশে৷ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ হয় যে দেশগুলোতে তার মধ্যে একেবারে প্রথম দিকেই রয়েছে বাংলাদেশ৷ কৌতুক করে অনেক সময় বাংলাদেশকে তাই ‘দুর্যোগের সুপারমার্কেট'ও বলা হয়৷ এসব দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতিও হয় প্রচুর৷ গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত ২০ বছরে ১৮৫টি আবহাওয়াজনিত তীব্র দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছে; যার ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷
এই যে ভয়ংকর বাস্তবতা, এ থেকে রক্ষা পেতে আমরা কী করছি? প্রকৃতিকে তো আমরা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না৷ কিন্তু তারপরও যে সকল কাজ করলে দুর্যোগের তাণ্ডব কিছুটা হলেও কমানো যায়- সে দিকে অবশ্যই আমাদের নজর দেওয়া দরকার ছিল৷ সেটা কি আমরা করেছি? অনেক বড় বড় ঝড়, সাইক্লোনকে প্রতিরোধ করেছে আমাদের সুন্দরবন৷ সুন্দরবনের ঘন গাছগুলো ঝড়ের গতিকে অনেকটাই দুর্বল করে দিয়েছে বছরের পর বছর৷ কিন্তু মানুষের অত্যাচারে সেই সুন্দরবনও এখন ক্লান্ত, দুর্বল৷ সুন্দরবনে চলছে বছরের পর বছর ধরে নির্বিচারে গাছ কাটা৷ বনের গাছের ক্ষতি হয়- এমন কর্মকাণ্ডও অবাধে চলছে আশপাশে৷
আমাদের এই ভূখন্ডে সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের উদাহরণ হচ্ছে ১৯৭০ এর সেই প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড়৷ সেই ঝড়ে কমপক্ষে দশ লক্ষাধিক প্রাণহানি হয়েছিল৷ আসলে এত বিপুল প্রাণহানির পিছনে ঝড়ের শক্তি যতটা কাজ করেছে, তারচেয়েও বেশি করেছে তৎকালীন পাকিস্তানী সামরিক সরকারের নিস্পৃহ আচরণ৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তারা কোন পদক্ষেপই নেয়নি৷ আসলে পুরো পাকিস্তান শাসনামলেই সেরকম কোন ব্যবস্থাপনার কথা তাদের চিন্তায় ছিল না৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নিয়ে আসলে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার পর থেকে৷ সে কারণেই বলা যায় বাংলাদেশের দুর্যোগের ইতিহাস যত দীর্ঘ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ইতিহাস ততটা নয়৷
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা যে কিছুটাই অগ্রসর হতে পারিনি- তেমন বলা যাবে না৷ ১৯৭০ এর সেই প্রলয়ংকরী ঝড়ের মতো ক্ষয়ক্ষতি আর হওয়ার কোনো আশংকা নেই৷ সেই রকম শক্তির ঝড় এলেও নয়৷ ২০২০ সালে যখন আম্ফান ঝড় এলো, সেটার গতিবেগ কিন্তু কম ছিল না৷ কিন্তু প্রাণহানি তেমন একটা হয়নি৷ কারণ আর কিছু নয়, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছিল, সরকারও সহযোগিতা করেছিল৷ ঝড়ের আগাম বার্তা আগে মানুষেরা বিশ্বাস করত না, এখন নিজেরাই সেসব খবর সংগ্রহ করে৷ তারপর নিরাপদ জায়গায় সরে যায়৷ আম্ফানের সময় উপকূল এলাকা থেকে প্রায় ২৮ লাখ মানুষকে ঝড়ের আগেই সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল৷ ফলে আম্ফানের তান্ডবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, বাড়িঘর উড়ে গেছে, কিন্তু প্রাণহানি তেমন ঘটেনি৷
মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এই সময়ে সাইক্লোন শেল্টারও তৈরি করা হয়েছে প্রচুর৷ এ কাজে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোও বেশ সাহায্য করেছে৷ এক ইউএসএআইডি-ই উপকূলবর্তী অঞ্চলে সাতশ'টিরও বেশি সাইক্লোন শেল্টার তৈরি করে দিয়েছে৷
এসব পরিসংখ্যান অবশ্যই ইতিবাচক৷ কিন্তু যে কোন দুর্যোগে পরিসংখ্যানের চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে মানবিকতা, আন্তরিকতা৷ যখন বন্যা হয়, বাড়ি ঘরে পানি ঢুকে যায়, বন্যার পানি নামতে দেরি হয়, তখন কিন্তু কেবল ত্রাণের এক দেড়শ' টান চালের হিসাব দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যায় না৷ সুস্থ জীবন যাপনের জন্য কেবল যে ভাতের বাইরেও অনেক কিছু লাগে৷ কিছুদিন আগে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির এক শীর্ষ কর্মকর্তা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে বেশ গর্ব করেই জানান, তাদের নাকি সাত লাখ ভলান্টিয়ার রয়েছে৷ দুর্যোগের সময় তারা নাকি দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রতিজ্ঞবদ্ধ৷ আসলে এটাও নিছক একটা পরিসংখ্যান৷ বাস্তবে এই সাত লাখের কতজনকে মাঠে পাওয়া যায়? হাওর অঞ্চলে দুতিন বছর পরপর উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে আসে৷ এই ঢল আসে ঠিক ফসল কাটার সময়ে৷ এমনও দেখা গেছে, মাঠ ভর্তি পাকা ধান, ঢলের পানি নামছে, কিন্তু ধান কাটার লোকের অভাবে কৃষক সেটা ঘরে তুলতে পারছে না৷ ওই সব ভলান্টিয়ারদের সেসময় কোথাও দেখা যায়নি৷ ধান বাঁচাতে সরকারকেও তখন কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না৷ অথচ হাওর অঞ্চলে ফসল রক্ষায় সরকারের ব্যয় কিন্তু কম নয়৷ তারা নানা উদ্ভট উদ্ভট পরিকল্পনা হাতে নেয়, বাঁধ বানায়, কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে৷ তারপর উজানের ঢল যখন আসে, সে বাঁধ কিছুমাত্র প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে না৷ এমন অপব্যয় আর অপচয় চলছে বছরের পর বছর ধরে৷ হাওরের ফসল রক্ষায় কেন এত বছরেও সরকার কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিয়ে পারল না, সেটাও এক বিশাল রহস্য৷ এরকম রহস্য থেকে বের হওয়ার কোনো প্রচেষ্টা যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কখনো দেখা গেছে- তাও নয়৷ তারা বরং দুর্যোগ আবির্ভূত হওয়ার পর অপ্রতূল ত্রাণ নিয়ে যেয়ে সেখানে বিতরণ নাটকেই বেশি আগ্রহ দেখিয়ে থাকে৷ দুর্গত মানুষেরা জানে, তাদেরকে আসলে বেঁচে থাকতে হবে নিজের চেষ্টাতেই, লড়াই করেই৷ তাঁরা সেটাই করে৷ লড়াই করতে করতেই তারা লড়াইয়ের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিস্কার করে, নিজের মতো করে টিকে থাকে৷ আর এভাবে যখন তারা টিকে যায়, সেই কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য সুবেশধারী কর্তারা নানা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন৷ তবে সেসব নিয়ে সাধারণ মানুষ তেমন একটা মাথা ঘামায় না৷ কারণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, তারা তো এসব দেখে আসছে৷ এসবে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে৷