আলোর দিশারি ‘বাংলাব্রেইল’
১০ এপ্রিল ২০১৪স্বেচ্ছাসেবীর দল বলছেন, দৃষ্টিহীনদের জন্য পাঠ্যবইয়ের ডিজিটাল সংস্করণ তৈরি ও অডিও বুক তৈরির কাজ আরো বেগবান করতে পারে আগ্রহীদের স্বেচ্ছাশ্রম৷ এছাড়া ব্রেইল বই ছাপানো এবং শিক্ষার্থীদের হাতে অডিও বুক পৌঁছে দেয়ার কাজটি অনেক সহজ করে দিতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা৷
ডয়চে ভেলের ‘দ্য বব্স – বেস্ট অফ অনলাইন অ্যাক্টিভিজম অ্যাওয়ার্ড'-এর চূড়ান্ত পর্বে সেরা উদ্ভাবন বিভাগে লড়ছে বাংলাব্রেইল৷ ১৪টি ভাষার প্রতিযোগীদের এ লড়াইয়ে বাংলাব্রেইলই বাংলার একমাত্র প্রতিনিধি৷
বাংলাব্রেইলের স্বেচ্ছাসেবীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাগিব হাসান, যিনি ইউনিভার্সিটি অফ আলাবামা অ্যাট বার্মিংহামে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান, নতুন বই প্রণয়নসহ বিভিন্ন কারণে শিক্ষাবর্ষের ছয় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও বাংলাদেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষারর্থীরা পাঠ্যবই পাচ্ছিল না৷ ২০১৩ সালের ২৬শে জুন বিষয়টি জানতে পেরে কিছু করার তাড়না থেকেই এগিয়ে আসেন রাগিব৷
তাঁর কথায়, ‘‘খবরটা পড়ে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল৷ আমাদের যাদের দৃষ্টিশক্তি আছে, তারা কোনোদিন কল্পনা করতে পারব না – পড়ালেখা বা কোনোকিছু জানা দৃষ্টিহীনদের জন কতটা কষ্টকর৷''
এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে খুঁজতে দুটো বিষয় রাগিবের মাথায় আসে৷ তিনি ভাবলেন, পাঠ্যবইগুলোর ডিজিটাল সংস্করণ তৈরি করা গেলে পরে তা ব্রেইলে রূপান্তর করে ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছে দেয়া সম্ভব৷ আর বইগুলো কণ্ঠে ধারণ করে ‘অডিও বুক' তৈরি করা গেলে সেগুলোও শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে৷
একার পক্ষে এ কাজ কঠিন, রাগিব তাই সহযোগিতা নিলেন ফেইসবুকের৷ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রথম দিনই দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন ব্রেইল বই তৈরির ‘প্রোজেক্টে' শামিল হয়ে গেলেন প্রায় ৫০০ স্বেস্ছাসেবী৷
‘‘আমি ভেবেছিলাম, খুব বেশি হলে হয়ত ১০-২০ জন আসবে৷ কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে প্রায় শখানেক লোক ফেইসবুকে সাড়া দিলেন৷ তাঁরা জানালেন, সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তারা এই প্রোজেক্টে কাজ করতে আগ্রহী৷''
এরপর ফেইসবুকে তৈরি হলো নতুন গ্রুপ বাংলাব্রেইল৷ দুই দিনের মাথায় সদস্য সংখ্যা হাজার পেরিয়ে গেল৷ বর্তমানে এর স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা প্রায় ২৮০০৷
এক বছরের অগ্রগতি
রাগিব বলেন, ‘‘কাজটা কীভাবে করব – তা ভেবে বের করতে প্রথম দিকে অনেকটা সময় লাগলেও গত প্রায় ১ বছরে আমরা যথেষ্ট এগিয়েছি৷ স্কুল পর্যায়ে ক্লাস ওয়ান থেকে নাইন-টেন পর্যন্ত প্রায় ১০০ বই আছে৷ আমরা এরই মধ্যে এর প্রায় এক চতুর্থাংশ, অর্থাৎ ২৫টি বইয়ের ডিজিটাল সংস্করণ এবং আরো ২৫টি বইয়ের অডিও সংস্করণ তৈরি করতে পেরেছি৷''
কেবল তরুণরাই নন, পেশাজীবী, গৃহিনীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নানা বয়সি মানুষ সাড়া দিয়েছেন বাংলাব্রেইলের ডাকে৷ তাঁরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে পাঠ্যবইগুলোর টেক্সট প্রথমে ইউনিকোডে রূপান্তর করছেন৷ এভাবে সেগুলো ব্রেইল প্রিন্টারে ছাপার জন্য তৈরি করা হচ্ছে৷
এছাড়া পাঠ্য বইগুলোকে পড়ে অডিও রেকর্ড করে তৈরি হচ্ছে অডিও বুক৷ ফাইলগুলো ইন্টারনেটে আপলোড করে রাখা হচ্ছে, যাতে দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা মোবাইল ফোনে তা ডাউনলোড করে নিয়ে ব্রেইল বই হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত কাজ চালাতে পারেন৷
সামনে কঠিন পথ
এ পর্যন্ত স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ চালিয়ে এলেও রাগিবদের সামনের পথ বেশ কঠিন৷ ডিজিটাল বইগুলো ব্রেইল প্রিন্টারে ছেপে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে হবে৷ আর এ কাজে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ব্রেইল প্রিন্টার আর কাগজের দাম৷
রাগিব জানান, একটি মোটামুটি মানের ব্রেইল প্রিন্টার কিনতেও কমপক্ষে ৮০ হাজার ডলার প্রয়োজন৷ তার ওপর ব্রেইলে ছাপার খরচও অনেক বেশি৷
প্রথম দিকে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ব্রেইল প্রিন্টার থেকে এসব বই ছাপার পরিকল্পনা হয়৷ কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদশিও বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত৷ কিন্তু বাংলাব্রেইলের প্রয়োজন স্থায়ী সমাধান৷
রাগিব বলেন, ‘‘বই ছাপার খরচ বা কোথাও ছাপানোর সুবিধা যদি পাওয়া যেত, সেটা আমাদের অনেক কাজে আসতো৷ আর আমাদের তৈরি করা অডিও বইগুলোও খুব দ্রুত সবার কাছে পৌঁছে দিতে চাই৷....কিন্তু বহু শিক্ষার্থীর এখনো ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ নেই৷ তাঁদের কাছে আমদের অডিও বইগুলো পৌঁছে দেয়ার কোনো ব্যবস্থা করা গেলে, প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সাহায্য পাওয়া গেলে সটা আমাদের খুব কাজে দিত৷''
অডিও বুকে আসবে কালজয়ী সাহিত্য
কম্পিউটার বিজ্ঞানের এই শিক্ষক জানালেন, তাদের প্রথম লক্ষ্য স্কুল পর্যায়ের সবগুলো বই শেষ করে ফেলা৷ তারপর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বইগুলোও তারা বাংলাব্রেইলে আনতে চান৷ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টহীন শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে যোগাযোগ করে তাঁদের সমস্যাগুলো জানিয়েছেন৷
‘‘তার পাশাপাশি আমাদের একটি লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন সাহিত্যকর্মের অডিও বুক তৈরি করা, যাতে দৃষ্টিহীনরাও ভালো সাহিত্যকর্মের রস নিতে পারেন, জানতে পারেন৷''
রাগিব জানান, বাংলা ব্রেইল প্রোজেক্ট চালু হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন৷ একজন অভিভাবক মেইল করে জানিয়েছেন যে, তাঁর ১১ বছরের মেয়েটি দৃষ্টিহীন৷ পড়ালেখায় খুব আগ্রহ থাকলেও পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণের অভাবে তা বন্ধ হতে বসেছে৷
‘‘এই অভিভাবক আমাদের খুব আকুতি জানিয়ে লিখেছেন, আমাদের এই প্রোজেক্ট যাতে চালিয় নিয়ে যাই৷ অডিও বুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে যাতে জ্ঞানের আলোটুকু তার বাচ্চার কাছে পৌঁছে দিতে পারি৷ অভিভাবকদের এ ধরনের বার্তা আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেয়৷''
দ্য বব্স-এ বাংলাব্রেইল
এ প্রতিযোগিতায় বাংলাব্রেইলকে এগিয়ে নিতে চাইলে প্রয়োজন বেশি বেশি ভোট৷ ভোট দিতে চাইলে ভিজিট করুন thebobs.com/bengali ওয়েবসাইট৷ এরপর সেখানে লগ-ইন করুন ফেসবুক, টুইটার, ভিকন্টাক্টে কিংবা ডয়চে ভেলের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে৷ তারপর ‘সেরা উদ্ভাবন' বিভাগ বাছাই করে বাংলাব্রেইল এর ঘরে বোতাম চেপে দিন আপনার ভোট৷
আগামী ৭ই মে পর্যন্ত প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একটি ক্যাটাগরিতে একটি করে ভোট দেয়া যাবে৷
বাংলাব্রেইলের প্রতিনিধি রাগিব বলেন, ‘‘ভোটে জিতি বা না জিতি সেটা বড় ব্যাপার না৷ আসলে আমাদের মূল লক্ষ্য দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের কাছে বইগুলো পৌঁছে দেয়া৷ ডয়চে ভেলের ‘দ্য বব্স' প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যদি আরো বেশি মানুষ আমাদের এই উদ্যোগের কথা জানতে পারেন, শামিল হতে পারেন – সেটাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি৷''
বাংলাব্রেইলের ওয়েবসাইট http://www.banglabraille.org/ অথবা ফেইসবুক পেইজ ভিজিট করে শিক্ষার আলো হাতে দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে পারেন যে কেউ৷