দেশ গড়ার কাজে রত মুক্তিযোদ্ধা রওশন জাহান
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পরদিনই পাক বাহিনী আটক করে নারী নেত্রী রওশন জাহান সাথীকে৷ তবে নিজের বুদ্ধিমত্তায় ফিরে আসেন আত্মীয়ের বাড়িতে৷ অবশ্য তাঁকে গৃহবন্দি করে রেখেছিল পাক সেনারা৷ তবুও একদিন শহর ফাঁকা দেখে সুযোগ মতো শহর ছেড়ে পালিয়ে যান রওশন জাহান এবং তাঁর সঙ্গীরা৷ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত গিয়ে পৌঁছান৷
অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই দেশত্যাগের ঘটনা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘একদিন শহর কিছু সময়ের জন্য ফাঁকা ছিল৷ তখন দেখি হাজার হাজার মানুষ গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে৷ তখন আমরাও পায়ে হেঁটে দুটো-তিনটে গ্রাম পেরিয়ে তিন-চারদিন গ্রামে ছিলাম৷ এরপর আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে বনগাঁর দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি৷ আমাকে যখন আটক করেছিল, তখন আমার চাচাতো ভাইকেও আটক করেছিল পাক সেনারা৷ তবে সৌভাগ্যবশত আমিও ছাড়া পাই, সেও ছাড়া পেয়েছিল৷ সেই ভাই আমাদেরকে তার গাড়িতে করে বেনাপোলের দিকে পৌঁছে দিচ্ছিল৷ কিন্তু আমরা যখন শহরের প্রায় শেষ প্রান্তে তখন দেখি পাক সেনারা গাড়ি বহর নিয়ে বেরিয়েছে৷ তখন শহরের প্রান্তে একটি বেসামরিক গাড়ি যেতে দেখে পাক সেনারা শিলাবৃষ্টির মতো গুলি করতে থাকে৷ আমরা গাড়ির সিটের নিচে শুয়ে পড়ি৷ গাড়িও খুব জোরে চালানো হচ্ছিল৷ গুলি এসে গাড়ির ছাদে এবং বডিতে লাগতে থাকে৷ কিছুক্ষণ পর এক ঝাঁক গুলি এসে ডান দিকের জানালায় এবং চাকায় আঘাত করে৷ জানালার কাঁচ সশব্দে ভেঙে পড়ে৷ চাকা ফেটে গিয়ে গাড়িটি ঘুরপাক খেতে থাকে৷ বেনাপোল যাওয়ার পথে গ্র্যান্ডট্রাঙ্ক রোডের পাশে বড় বড় গাছ ছিল৷ সেগুলোতে গিয়ে ধাক্কা খেল গাড়িটি৷ তবুও আমরা দেখলাম যে, তখনও বেঁচে আছি৷ উল্টোদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এসে গাড়িটিতে চাকা পরিয়ে দেয়৷ এরপর সেই ভাঙা গাড়ি নিয়েই আমরা বেনাপোলে গিয়ে পৌঁছাই৷''
বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে ভারত যাওয়ার পর রওশন জাহান সাথী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তাঁর বাবার সাথে দেখা করেন৷ তখনই তিনি জানতে পারেন যে, তাঁর বাবাই প্রথম কোন বাংলাদেশি নেতা যিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করে যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁকে অবগত করেছিলেন৷ এ ব্যাপারে রওশন জাহান বলেন, ‘‘আমার বাবা নতুন দিল্লিতে গিয়ে প্রথম ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করে তাঁকে সবকিছু জানান৷ যদিও আমরা এ কথাটি কোথাও লেখা দেখি না৷ কিন্তু এটির একটি স্মৃতি আমাদের কাছে আছে৷ ইন্দিরা গান্ধী বাবাকে একটি স্মারক উপহার দেন৷ সেটি এখনও আমাদের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে৷''
বনগাঁ পৌঁছে পরিকল্পনা অনুসারে মুক্তিযুদ্ধের কাজ শুরু করেন রওশন জাহান সাথী৷ যুদ্ধকালীন দুঃসময়ে শরণার্থী শিবিরে ত্রাণকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন৷ সীমান্ত এলাকায় প্রচারপত্র বিলি করেছেন৷ এছাড়া বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর নেতাদের সাথে নানা কাজের মধ্যে নিয়োজিত ছিলেন তিনি৷
১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে তাঁর পিতা দেশে ফিরে দেখেন তাঁদের বাড়িকে রাজাকারদের ঘাঁটি বানানো হয়েছিল৷ বাড়ির ভেতরে এবং চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের খুনের রক্ত৷ রাজাকাররা সেই বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নানা শাস্তি দিতো এবং খুন করতো৷ বাড়ির পাশের পুকুরেও পাওয়া গিয়েছিল মানুষের ছিন্ন-ভিন্ন দেহাবশেষ ও অস্ত্র-শস্ত্র৷
মুক্তিযোদ্ধা রওশন জাহান সাথী দেশে ফিরে দেখেন সারাদেশের রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালতের ধ্বংসস্তূপ৷ তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আবার নতুন করে গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করেন তিনি৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে গড়া ছাত্রলীগের পতাকা তলে থেকে দেশ গড়ার কাজ করতে থাকেন৷ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন রওশন৷ একইসাথে লেখাপড়াও চালিয়ে যান তিনি৷
১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন৷ পরের বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ থেকে রোকেয়া হলের ভিপি নির্বাচিত হন৷ এছাড়া ছাত্রজীবনে লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতেন সাথী৷ বর্তমানে মহিলা শ্রমিক লীগের সভাপতি এবং জাতীয় শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলা সম্পাদক৷ এছাড়া জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে দেশ ও জাতি গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন বীর সাহসী নারী রওশন জাহান সাথী৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন