এনআরসি জুজু দেখাচ্ছে বিজেপি
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি বিদেশিমুক্ত করার কথা বলে আসছে কেন্দ্রের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি৷ আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পর শাসক দল ও সরকারের পদাধিকারীরা জোর গলায় বলে বেড়াচ্ছেন, অন্য রাজ্যেও এনআরসি চালু করা হবে৷ বিশেষত করে পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানায়৷ ফলে দেশজুড়ে এক ধরনের এনআরসি জুজুর ভয় ছড়িয়ে পড়ছে৷
নিয়ম অনুযায়ী, কোনো রাজ্যে এনআরসি চালু করতে হলে সেই বিষয়ে প্রস্তাবিত আইন পেশ করতে হয় সংসদে৷ সংসদের অনুমোদন ছাড়া তা সম্ভব নয়৷ এক আসাম নিয়ে সরকার ও শাসক দলের নাজেহাল দশা৷
এর উপর অন্য রাজ্যে এনআরসি চালু করার কোনো প্রস্তাব সংসদে পাশ হওয়া তো দূরের কথা পেশ করাই হয়নি৷ অতএব এখনই তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না৷ যদিও কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলো মনে করছে, এনআরসিকে সামনে রেখে দেশে অর্থনীতির করুণ দশা থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে মেরুকরণের রাজনীতি করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্ণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২০ সালে এনপিআর বা ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্ট্রার চূড়ান্ত হবে৷ তা আগামী দিনে গোটা দেশে এনআরসির ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে৷ এখন প্রশ্ন হল, তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষ কোথায় যাবে? সরকারি বিবৃতিতে বলা হচ্ছে, কারও নাম এনআরসিতে না থাকলেই তাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে, এমনটা নয়। বরং আইনের মাধ্যমে নাগরিকপঞ্জিতে নাম তোলার জন্য আবেদন জানানো যাবে৷ সেজন্য ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হবে৷ ট্রাইব্যুনাল যদি কোনো ব্যক্তিকে ভারতীয় নাগরিকত্বের স্বীকৃতি না দেয়, সেক্ষেত্রে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্টেও আবেদন করা যাবে৷
ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরি বললেন, ‘‘দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের উদ্দেশ্য নেই৷ সাম্প্রদায়িক ইস্যু তৈরি করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার লক্ষ্যে অহেতুক জটিলতা তৈরি করা হচ্ছে৷ অবিবেচকের মতো বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে৷ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ফেরৎ পাঠানোই যদি প্রকৃত উদ্দেশ্য হয় তাহলে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা হল না কেন? তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদের সঙ্গে কি করা হবে? এর জবাব দিতে হবে সরকারকে৷''
১৯৫১ সালে অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি হয়েছিল৷ ওই রাজ্যে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়নের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে৷ ২০১৮ সালের জুলাইয়ে খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল প্রায় ৪০ লাখ মানুষ৷ বার চূড়ান্ত তালিকায় ১৯ লাখ বাসিন্দার৷
বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মনে রাখতে হবে ভারত দেশটা ধর্মশালা নয়৷ পৃথিবীর কোনো দেশে বিদেশিদের স্থায়ীভাবে থাকতে দেওয়া হয় না। অনুপ্রবেশকারীদর মধ্যেও হিন্দু-মুসলমান কেন খোঁজা হচ্ছে, এ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করছেন৷ কেন নয়, ১৯৪৭ সালে দেশটা তো ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিল৷
বরিশাল, খুলনার বহু মানুষ ধর্মীয় কারণে এদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ আমাদের দল ও সরকার চাইছে এনআরসির মাধ্যমে বিদেশিদের তাড়ানো হোক, অবশ্যই মুসলমানদের৷ কারণ অমুসলিমরা অত্যাচারিত৷ এটা বিজেপির সৃষ্টিলগ্নের আদর্শ৷ বাংলাদেশি মুসলমানদের বিতাড়িত করতে একদিকে যেমন এনআরসি চালু থাকবে, পাশাপাশি ২০১৪ সাল অবধি অমুসলমান শরণার্থীদের এ দেশের নাগরিকত্ব দিতে সংসদে ‘নাগরিকত্ব বিল' পাশ করানো হবে৷''
ইতিহাসবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতের মতো বৈচিত্রময় গণতান্ত্রিক দেশে কোনো সরকারের পক্ষে গায়ের জোরে এতগুলো মানুষকে বিতাড়ন করা কখনোই সম্ভব নয়৷ তা সে যে রাজনৈতিক মতাদর্শেই বিশ্বাসী সরকার হোক না কেন৷ তবে অনুপ্রবেশকারী ও এনআরসিকে রাজনৈতিক ইস্যু করে ক্ষমতায় আসা সরকার যে চিহ্নিত মানুষদের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা' নিতে চাইবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই৷ সেক্ষেত্রে সরকারি সুযোগ-সুবিধা, সরকারি পরিচয়পত্র ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত রাখার পন্থা অবলম্বন করা হতে পারে৷ কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ‘ভিনদেশী' শনাক্ত করে বলপূর্বক দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে পারবে না সরকার৷