দেশি মিডিয়া যে কারণে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেনি
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১বাংলাদেশে প্রতিবেদনটি দেখতেও এখন পর্যন্ত কোনো বাধার সৃষ্টি করা হয়নি৷ সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের অবস্থান কী?
ইরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার তাদের সম্পাদকীয়তে এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে৷ সম্পাদকীয়র শিরোনাম ‘আওয়ার টেক অন দ্য আল জাজিরা রিপোর্ট’৷ সেখানে এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘‘কোন বিষয়ে সরকার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে তা প্রকাশ না করে কেবলমাত্র সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা অদ্ভুত এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি৷ এখন পর্যন্ত আমরা আল জাজিরার প্রতিবেদন বা এর কোনো অংশই প্রকাশ করিনি৷’’
অবশ্য তাদের সম্পদকীয়তে বিষয়গুলো নিয়ে তদন্তের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হয়েছে৷ তারা বলছে, ‘‘আমরা মনে করি যে প্রতিবেদনে উত্থাপিত অভিযোগগুলো এড়িয়ে যাওয়া বা কার্পেটের নিচে ময়লা চাপা দেওয়ার মতো সমাধানে যাওয়া সঠিক হবে না৷’’
বাংলাদেশের গণমাধ্যম কেন আল জাজিরার প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি তারও একটা ধারণা দিয়েছে দ্য ডেইলি স্টার৷ তার বলছে, ‘‘আমাদের নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা তো রয়েছে, তার পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রভাবে পরিবেশটি এমন হয়ে উঠেছে যে, কোনো জায়গায় মুক্তভাবে গণমাধ্যমের কাজের ক্ষেত্র এই আইনটি ব্যাপকভাবে সীমাবদ্ধ করেছে৷ সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় করা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অসমর্থনযোগ্য মানহানিকর মামলাগুলো দেখলে এবং যে গতিতে মামলাগুলো নেওয়া হয়, তদন্ত করা হয়, আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়, কারাগারে পাঠানো হয় ও মাসের পর মাস জামিন না দিয়ে কারাবন্দি রাখা হয় তাতেই সুস্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়৷ এগুলো ছাড়াও ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়া এবং বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়াসহ অন্য আরো যে কৌশলগুলো ব্যবহার করা হয় তা বলাই বাহুল্য৷’’
দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের কাছে এনিয়ে আরো একটু বিস্তারিত মন্তব্য জানতে ফোন করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি যা মনে করি তা পত্রিকায় লিখি, আলাদা করে মন্তব্য দেই না৷ ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয়তে আমাদের পত্রিকার মতামত প্রতিফলিত হয়েছে৷ এনিয়ে আমার কোনো আলাদা মন্তব্য নাই৷’’
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের আরো কয়েকটি প্রভাবশালী দৈনিক ও টেলিভিশন চ্যানেলের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে ফোন করলে তাদের একাংশ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি৷ তবে কেউ কেউ কথা বলেছেন৷ তাদের একজন সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান৷ তিনি মনে করেন, ‘‘আল জাজিরার প্রতিবেদনটি কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নয়৷ এখানে ড্রামা করা হয়েছে৷ যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে তার অনেকটাই এর আগে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে৷ নতুন দুই একটি তথ্য রয়েছে৷ হারিস যে হাসান নাম ধারণ করেছে এটা নতুন৷ আর সেনা প্রধানের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে তার ভাই যারা পলাতক আসামি তাদের উপস্থিতির খবরও নতুন৷’’
অবশ্য তিনি এও মনে করেন সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে, ‘‘তাও স্মার্ট হয়নি, এফেকটিভ হয়নি,বিশ্বাসযোগ্য হয়নি৷ প্রতিক্রিয়া তো বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে৷ গৎবাঁধা কথা তো বলে দিলে হয় না৷’’
তার মতে, ‘‘বাংলাদেশে আল জাজিরার ওই প্রতিবদেন এখন পর্যন্ত যে কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়নি এটা একটা সাহসী কাজ৷ ভবিষ্যতে কী হবে জানি না৷ বাধাগ্রস্ত হতেও পারে৷ তবে এর প্রতিবাদ জানানোর কোনো প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি না৷ আমি হলে করতাম না৷ কারণ এই প্রতিবাদের মাধ্যমেই আবার বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে৷’’
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম কেন প্রকাশ করেনি এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আপনি এমনভাবে প্রশ্ন করলেন যে এটা জীবনে এই প্রথম ঘটলো৷ আমরা তো কত কিছুই ছাপি না৷ কেন ছাপি না তা ওই তো ডেইল স্টারের এডিটোরিয়ালেই আছে৷ আমরা অনেক সময় নিজেরাও বুঝি না কোনটা কোন আইনে আমাদের জন্য একটা ট্র্যাপ হতে পারে৷ আমরা সকলে মিলে বার বারই বলেছি যে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট আমাদের জন্য বিপজ্জনক৷ যতক্ষণ পর্যন্ত আইনের পরিবর্তন না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করছি৷’’
তবে তার মতে, পত্রিকা টেলিভিশন বা অনলাইন এটা প্রকাশ না করলেও এটা নিয়ে কিন্তু নানা ধরনের আলোচনা চলছে৷ খবরে না হলেও টকশোতে আলোচনা হচ্ছে৷ সেখানে কিন্তু আল জাজিরার প্রতিবেদনের রেফারেন্স ব্যবহার করতে গিয়ে প্রকাশ হচ্ছে৷ আমিও তো প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলছি৷ আর প্রতিবাদ ছেপেও আমরা প্রকারান্তরে আল জাজিরার প্রতিবেদন কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ করেছি৷ এটা না ছাপলে তো মনে হতো আল জাজিরায় কিছুই ঘটেনি৷
একাত্তর টেলিভিশনের হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদ মনে করেন, মিডিয়ার একটি বড় রোল হচ্ছে দেশ , জাতি ও সমাজের বিষয় মাথায় রেখে খবর প্রকাশ করা৷ অ্যামেরিকায় যে টেলিভিশনগুলো পরিচালিত হয়, যখন ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়, তখন কিন্তু তারা অ্যামেরিকার স্বার্থের কথা মনে রাখে৷ সব তথ্য প্রকাশ করার যে নীতি তা সব দেশে কার্যকর নয়৷ আল জাজিরা যে প্রতিবেদন করেছে তার বেশিরভাগই একপক্ষীয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং কোনো না কোনো পক্ষের সাথে যুক্ত থেকে তারা এই প্রতিবেদন করেছে৷ যে পাঁচজনের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতে মামলা আছে৷ ফলে তাদের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন করায় বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা প্রতিবেদনটি এক ধরনের বর্জন করেছে৷
তিনি মনে করেন, ‘‘প্রতিবাদ ছাপার সময় যদি ওই তথ্য বা ঘটনা আবার উল্লেখ করা হয় তাহলে তো তাদের তথ্য আবার ছড়িয়ে দেয়া হলো৷ তাদের তথ্য তো সুনির্দিষ্ট নয়৷ তারা খুব দূর থেকে বাংলাদেশকে দেখেছে৷’’
আল জাজিরার ওই খবর প্রকাশ না করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কোনো পক্ষ থেকে কোনো চাপ ছিল না বলে জানান দৈনিক ‘দিনকালের' সম্পাদক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী৷ তিনি বলেন, ‘‘শুধু আমরা কেন বাংলাদেশের কোনো সংবাদমাধ্যমই প্রকাশ করেনি৷ আমরা সাহস পাইনি, সাহসের অভাব ছিলো৷ আমরা সেল্ফ সেন্সর করেছি৷’’
কোনো চাপ না থকলেও কিসের ভয়? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমি চিন্তা করেছি এটা প্রকাশ করলে আমি সরকারের দিক থেকে কোনো জুলুমের শিকার হতে পারি৷ তাই অপেক্ষা করেছি বাংলাদেশের আর কোনো সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করে কিনা৷ কেউ করলে আমরাও করতাম৷’’
এই ভয়ের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘দেশের পরিস্থিতিই এরকম৷ এখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই৷ এখনো যতটুকু পারা যায় সেটাও যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তো হবে না৷ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আমাকে কোনো কারণ ছাড়াই ধরে নিয়ে যেতে পারে৷ তাই আমি ঝুঁকি নেইনি৷ আমি একা নই, কেউই নেয়নি৷’’