দেশে কি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়ছে?
৩০ অক্টোবর ২০২০মহানবী হযরত মুহাম্মদ(সা.) কে নিয়ে ফ্রান্সে ব্যঙ্গ কার্টুন প্রকাশ নিয়ে এখন বাংলাদেশও উত্তপ্ত৷ পণ্য বয়কটের আহ্বানের পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্কও ছিন্নের দাবি তুলছে ইসলামপন্থী দলগুলো৷ তবে এই ধরনের বয়কট-বর্জন এই প্রথম নয়৷
বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে ‘ইসলাম বিরোধী’ লেখা বাতিলের দাবিতেও একই রকম কর্মসূচি অতীতে পালন হয়েছে৷ সরকারের ‘নারী নীতিও’ তারা বাস্তবায়ন করতে দেয়নি৷ ব্লগার এবং ভিন্ন চিন্তার মানুষও তাদের বর্জন ও হত্যার হুমকির শিকার হয়েছেন৷ কেউ কেউ পেয়েছে ‘নাস্তিক’ উপাধি৷ আর সর্বশেষ দুর্গাপূজায় উত্তরার একটি মণ্ডপে পূজা বন্ধের আবেদন করা হয়েছিল মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কথা বলে৷
ঢাকায় সমাবেশে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে হত্যার হুমকি দিয়ে প্ল্যাকার্ড নিয়েও অংশ নিতে দেখা যায়৷
এই সব পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশে ধর্মীয় সহনশীলতা নিয়ে কি প্রশ্ন তোলা যায়? এমন প্রশ্ন কি করা যায় যে বাংলাদেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা আসন গেড়ে বসছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আকসাদুল আলম বলেন, ‘‘আমাদের এখানে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার অভাব দেখা যাচ্ছে৷ এটা প্রমাণিত যে অসহিষ্ণু একটি পরিবেশ তৈরি হচ্ছে৷ তবে এটা ঐতিহাসিকভাবে আমাদের এখানকার সমাজের প্রকৃত চিত্র নয়৷ কিছু ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে উত্তাপ ছাড়াচ্ছে৷ তাদের এই উন্মাদনার সঙ্গে দেশের অধিকাংশ মানুষের কোনো যোগাযোগ নাই৷’’
বয়কট বা প্রতিরোধের তারা যে ডাক দেন তার শক্তি কোথায় পান? তারা কার সাথে আলোচনা করে এটা করেন৷ তারা কি কোনো কর্তৃপক্ষ? তাদের কথা শুনে মনে হবে তারা দেশের সব মানুষের, ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন৷
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান বলেন, ‘‘তারা ধর্মকে পুঁজি করে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায়৷ তাই তারা যেমন ইস্যু তৈরির চেষ্টা করে, আবার কোনো ইস্যু পেলে তা ব্যবহার করে৷ আসলে এরা সুযোগসন্ধানী৷’’
তার মতে ইসলাম ও রসুল(সা.) -এর কেনো ধরনের অবমাননা করা হলে আমরা তার প্রতিবাদ নিশ্চয়ই করব৷ কিন্তু হত্যার হুমকি দেয়া, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা বা বর্জন করার হুমকি কোনে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ নয়৷ এটা নেতিবাচক মেসেজ দেয়৷
‘‘তারা যে এই বর্জনের ডাক দেয় এতে কোনো কাজ হয় বলে আমার মনে হয় না৷ ফ্রান্সের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক আছে৷ আমাদের অর্থনেতিক সম্পর্কও শক্ত ৷ সেটা তো বিবেচনায় রাখতে হবে,’’ বলেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক৷
তিনিও মনে করেন এই চিত্র বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন চিত্র ৷ প্রকৃত চিত্র নয়৷ এদেশের মানুষ ধর্মান্ধ নয়৷
অবশ্য এসব গোষ্ঠী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পায়৷ বাংলাদেশের দুইটি বড় রাজনৈতিক দলই তাদের গুড বুকে থাকতে চায়৷ তাদের চটাতে চায় না৷ এর কারণ কী? অধ্যাপক আকসাদুল আলম বলেন, ‘‘এই রাজনৈতিক দলগুলোর হিসাব আলাদা৷ তারা মনে করে ওই গোষ্ঠীগুলো পক্ষে থাকলে তাদের সুবিধা৷ তাদের অবস্থানের জন্য সুবিধা৷ কিন্তু একটি আদর্শ সরকার ও আদর্শ রাজনৈতিক দলকে মানুষের মর্যাদা ও গৌরবকে গুরুত্ব দিতে হয়৷ এটা একটা বহুত্ববাদী সমাজ তা বিবেচনায় রাখতে হবে৷’’
আর অধ্যাপক তারেক শামসুর রাহমান মনে করেন, ‘‘ওইসব গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দেয়া একটি রাজনৈতিক কৌশল৷ আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ সব বড় দলই এটা করে৷ বিশেষ করে ভোটের আগে৷ তবে এর প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর তেমন ড়ে না৷ কিন্তু এতে ওই গোষ্ঠীগুলো একটু একটু করে শক্তি সঞ্চয় করে৷ এটা ভালো লক্ষণ নয়৷’’
ইসলামি রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো ফ্রান্স ইস্যুতে এখন পুরো মাত্রায় মাঠে রয়েছে৷ তারা সরকারকে চাপ দিচ্ছে যে সরকারি পর্যায় থেকে ফ্রান্সের পণ্য বর্জনের ডাক দিতে হবে৷ তারা কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করারও দাবী তুলছে৷ ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ মনে করেন, বাংলাদেশের অনেক মুসলমানই এখন ফ্রান্সের কোনো পণ্য ব্যবহার করছেন না৷ তারা বর্জন করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ফ্রান্স তো অর্থনৈতিক শক্তির জোরে এসব করছে৷ পৃথিবীর সব মুসলমান তাদের বর্জন করলে তাদের এই শক্তি থাকবে না৷’’
তিনি বলেন, মুসলানের শরীরে শুধু রক্ত প্রবাহিত হয় না, মুসলমানের রক্তে, রগে রগে আল্লাহর নবীর প্রেম ও ভালোবাসা প্রবাহিত হয়৷ ফ্রান্সে যা হয়েছে তা ইসলামকে আক্রমণ করা , মুসলমানদের আক্রমণ করা৷ তাই এর প্রতিবাদ জানানো ঈমানী দায়িত্ব৷
তার মতে, ইসলামে সন্ত্রাসের কোনো জায়গা নাই, অসহিষ্ণুতার কোনো জায়গা নাই৷ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটতে পারে৷ সেজন্য ইসলামের অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে আইন করলে কোনো বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটবে না বলে তিনি দাবি করেন৷