1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: মধ্যবিত্ত মাথা ঢাকবে নাকি পা

শামীমা নাসরিন
১১ মার্চ ২০২২

ছেলের চুল কাটাতে গিয়েছি সেলুনে৷ চেনা নাপিত, নিয়মিত যাই৷ ঢুকতেই বললো, আপা এবার কিন্তু ১৩০ টাকা৷

https://p.dw.com/p/48Mcp
ছবি: Mortuza Rashed/DW

চোখ বড় করে বললাম, এক ধাক্কায় ৩০ টাকা বেশি, কারণ কী? আপা সব কিছুর দামইতো বাড়তি৷ মিনমিন করে বললাম, কিনতে তো আমাকেও হয়, এখন আপনাকেও ৩০ টাকা বাড়তি দিতে হবে৷

আজকাল যেটাই কিনতে যাই, চোখ বড় করতে হচ্ছে৷ পকেটে টান পড়ছে, হিসাব কষতে হচ্ছে৷ হিসাবের এই গোলকধাঁধায় পড়ে দিশেহারা মধ্যবিত্ত আমি৷ মাথা ঢাকতে গেলে পা বেরিয়ে পড়ছে, পা ঢাকতে গেলে মাথা৷

গত মাসে রূপচাঁদা সয়াবিন তেলের পাঁচ লিটারের জার কিনেছি ৭৫০ টাকায়৷ এ মাসে ১০০ টাকা বাড়তি গুণতে হয়েছে৷ মুদি দোকানি মানোয়ার ভাইকে বললাম, একটু কমায় রাখেন৷ ৩২ দাঁত বের করা হাসি দিয়ে মানোয়ার ভাই বললেন, ‘‘আপা কমায়াই রাখছি৷ অন্য দোকানে আরো দাম নেয়৷ আপনি বরং আরো একটা জার নিয়ে যান৷''

কেন?

‘‘দেখেন না আপা, ইউক্রেনে যেই যুদ্ধ লাগছে৷ তার উপর রোজা আসতেছে৷ তেলের দাম যে কই গিয়া থামবো! আমি ভালা বুদ্ধি দিতাছি৷''

মানোয়ার ভাইকে লজ্জায় বলতে পারি নাই, এই মাসেই দরকারের চেয়ে কম বাজার করতে হয়েছে৷ সামনের মাসে আরো কাটছাঁট করতে হবে৷

শুধু তেলের ‘তেলেসমাতি' নয়; চাল, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ সবই এক এক করে মধ্যবিত্তের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে৷ মসুরের ডাল ১৪০, পেঁয়াজ ৭০ ছুঁইছুঁই, চিনি ৮০ টাকা, নাজিরশাইল চাল কিনেছি ৮৩ টাকা কেজি দরে৷

এই যে সব কিছুতেই বাড়তি দাম৷ তা মেটাতে মাসের বাজার খরচে যোগ করতে হয়েছে বাড়তি তিন/সাড়ে তিন হাজার টাকা৷ বেতনের সঙ্গে তো এ টাকা যোগ হয়নি৷ তবে কোথা থেকে আসবে এই বাড়তি অর্থ৷

এবার তাই নামতে হচ্ছে কাটছাঁটের হিসাবে৷ প্রথমেই কাঁচি চলে নিজেদের শখের তালিকায়৷ এক/দু দিন রেস্তোরাঁয় খাওয়া বাদ দিতে হবে, ছেলের বায়নাতে কাঁচি চালাতে হবে৷ রিকশা ভাড়া বাঁচাতে হাঁটতে হবে৷

হাঁটা অবশ্য স্বাস্থ্যের জন্য ভালো৷ ভাতও কম খেতে হবে৷ ভাতের পরিবর্তে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে৷ গতবছর অক্টোবরে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক আমাদের এই পরামর্শ দিয়েছিলেন৷

পুষ্টিকর খাবার মানে তো মাছ-মাংস-ডিম-দুধ৷ যেগুলো আরো আগেই বাঙালি মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে৷ তাই আমার মত বেশিভাগ মধ্যবিত্ত ধরেই নিয়েছেন, পুষ্টিকর খাবার মানে শাকসবজি৷ কাল এক কেজি কচুর লতি কিনেছি ৯০ টাকায়৷ ঢাকায় অনেক দিন ধরেই ৫০/৬০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যায় না৷ একটা লাউ ৭০ থেকে ৮০ টাকা৷ নতুন সবজি ঢ্যাঁড়স চাইলো ১২০ টাকা কেজি, কিনিনি৷

শসা-দেশি টমেটোর সিজন এখন৷ তারপরও দাম ৬০ টাকার উপরে৷ অথচ সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে৷

কোভিড মহামারির ধাক্কায় গত দুই বছরে অনেক মধ্যবিত্ত চাকরি হারিয়েছেন৷ প্রায় সবারই দুই বছর ধরে এক টাকা বেতন বাড়েনি৷ উল্টে মহামারিতে ব্যবসা নেই অজুহাতে কারো কারো বেতনের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছেন মালিকপক্ষ৷

মধ্যবিত্ত অনেক ব্যবসায়ীর ব্যবসা অর্ধেকে নেমে গেছে৷ পুঁজি ভেঙ্গে চলার কারণে এখন ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়াতে পারছেন না৷ আশায় ছিলেন মহামারি গেলে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে৷

কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যাঁতাকলে পড়ে তাদের এখন পিষে মরার দশা৷ ‍অনেক মধ্যবিত্তই এখন নিম্নমধ্যবিত্তের কাতারে চলে গেছেন৷ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবি পণ্যের ট্রাক থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বাধ্য হচ্ছেন৷ সেখানেও দাম একেবারে কম না৷

আমার বাসায় কাজে সাহায্য করে সদা হাস্যোজ্জ্বল খাদিজা৷ কথা কথা ওকে জিজ্ঞাসা করি, খাদিজা ট্রাক থেকে যে জিনিস কেনেন দাম কেমন?

অবাক খাদিজা উত্তর দেয়, ‘‘আপা যে লম্বা লাইন পড়ে, অনেক সকালে যাইতে হয়, রোদের মধ্যে অনেক্ষণ দাঁড়ায় থাকতে হয়৷ তাও পাওন যায় না, আপনে পারবেন না৷”

আমি বললাম, না না আমি শুধু দাম জানতে চাচ্ছি৷ ও জানালো, দুই কেজি চিনি, দুই কেজি মসুর ডাল, ৫ কেজি পিঁয়াজ আর দুই কেজি তেলের একটি কম্বোপ্যাক নেয় ৫৮০ টাকা৷ আর চাল ৫ কেজি ১৫০, আটা ৫ কেজি ৯০ টাকা৷

শামীমা নাসরিন, সাংবাদিক
শামীমা নাসরিন, সাংবাদিকছবি: privat

খাদিজা আমার প্রশ্ন শুনেই যে ধরে নিল আমিও টিসিবি ট্রাকের সামনে লাইনে দাঁড়াতে চাচ্ছি তার কারণ বুঝতে পারি৷ আমরা মত মধ্যবিত্তরা যে লুকিয়ে, মুখ ঢেকে নিজেকে আড়াল করে ওই লাইনে ঢুকে পড়তে শুরু করেছে৷ লম্বা হচ্ছে লাইন, বাড়ছে প্রতিযোগিতা, হচ্ছে কাড়াকাড়ি৷

বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে এখন মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে৷ বাড়ছে মাথাপিছু আয়৷ কাগজে-কলমে বাংলাদেশে এখন পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের মাথাপিছু আয় ৯০ হাজার টাকার বেশি৷ অথচ বাস্তবতা ভিন্ন৷

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০১৭ থেকে ২০২১ এই চার বছরে মূল্যস্ফ্রীতির হার ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ৷ অর্থাৎ ২০১৭ সালে ১০০ টাকা দিয়ে যে পণ্য কেনা যেত ২০২১ সালে এসে সেটি কিনতে খরচ করতে হচ্ছে প্রায় ১৩১ টাকা৷

পণ্যমূল্যের বাস্তবতা কিন্তু সরকারি হিসাবের চাইতেও অনেক বেশি৷ গত পাঁচ বছরে জীবনধারনে অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের দাম ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে৷ এটা আমি বলছি না, এটা কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মনিটরিং সেলের তথ্য৷

গত পাঁচ বছরের মধ্যে করোনা খেয়ে দিয়েছে দুই বছর৷ তার আগের তিন বছরে আমার বেতন কিছুটা বেড়েছে বটে৷ কিন্তু ৫০ শতাংশ দাম বাড়ার সঙ্গে দৌড়ে কিছুতেই পেরে উঠছি না৷ ফলে কপালে চিন্তার ভাঁজ স্থায়ী হতে শুরু করেছে, দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে বাজারের ব্যাগটা৷