ধর্ম অবমাননার অভিযোগ: সুনামগঞ্জে হামলা ও মানবিকতার দুই গল্প
৪ ডিসেম্বর ২০২৪সেখানে প্রতিরোধের দেয়াল গড়েছেন মুসলমান প্রতিবেশীরা৷
সুনামগঞ্জের দুয়ারাবাজার উপজেলায় মঙ্গলবার রাতে ‘ধর্ম অবমাননার’ কথিত এক ফেসবুক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বাজার ও সংলগ্ন একটি গ্রামে হিন্দুদের বাড়ি-ঘর ও মন্দিরে হামলা, লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। হামলার পর ওই এলাকার বেশ কিছু হিন্দু পরিবার ভয়ে এলাকা ছেড়েছে।
সেখানে যৌথ বাহিনীর নিরপত্তা জোরদার করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেহের নিগার তনুর দাবি, পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে।
ফেসবুকে ধর্ম অবমাননাকর মন্তব্য করার অভিযোগে আকাশ দাস নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা দেয়া হয়েছে।
১০০, কিংবা ৪-৫
হামলার শিকার পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে মঙ্গলবার রাতের হামলায় দুয়ারাবাজার ও পাশের একটি গ্রামের শতাধিক বাড়ি-ঘর, মন্দির ও দোকানপাটে হামলা, লুটপাট হয়েছে। এ হামলায় হতাহতের কোনো খবর এখনো পাওয়া যায়নি।
তবে হামলার শিকার পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যকে পুলিশ ও প্রশাসন ‘অতিরঞ্জিত তথ্য' বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের দাবি, মাত্র একটি মন্দির ও চার-পাঁচটি বাড়িঘরে হামলা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, মঙ্গলবার বিকেলের দিকে পবিত্র কোরআনের অবমাননামূলক একটি ফেসবুক মন্তব্যের কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তারপর লোকজন বাজারে জড়ো হয়ে প্রতিবাদ-সমাবেশ করে। সেই প্রতিবাদ-সমাবেশ ফেসবুক লাইভে প্রচার করা হয়। রাত ৮ টার দিকে প্রথমে দুয়ারাবাজারে, তারপরে পাশের মংলারগাঁও গ্রামে হামলা ও ভাংচুর চালানো হয়। পুলিশ অবশ্য হামলার আগেই আকাশকে মংলারগাঁও গ্রাম থেকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
আকাশের পাশের বাড়িতে থাকেন বিজন দাস। তার বাড়িতেও ভাংচুর ও লুটপাট হয়েছে। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আকাশকে পুলিশ নিয়ে যাওয়ার পর প্রথমে তাদের (আকাশ) বাড়িতে হামলা ও ভাংচুর হয়। তাদের বাড়িতে এখন আর কেউ নেই। এরপর পুরো গ্রামে সাত-আটশ' লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। আমার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে টাকা -পয়সা ও সোনাদানা যা ছিল, সব নিয়ে গেছে। আমি এখন বাড়িতে আছি। কিন্তু স্ত্রী ও মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার বাড়িতে আগুনও দেয়া হয়েছে।”
"আমাদের গ্রামে মোট ৮০টি হিন্দু বাড়ি আছে। তার মধ্যে ৭০টি বাড়িতেই হামলা ও লুটপাট হয়েছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই আতঙ্কে তখন চলে যায়। এখন ফিরতে শুরু করেছে,” বলেন তিনি।
ননিগাঁওয়ে মুসলিম প্রতিবেশীদের প্রতিরোধ
বিজন দাস আরো বলেন, "আমাদের পাশের গ্রাম ননিগাঁও । সেখানেও কয়েক বাড়ি হিন্দু আছে। ওই গ্রামটি মুসলিম-অধ্যুষিত। তারা ওই হিন্দুদের বাড়িতে আক্রমণ করতে দেয়নি।”
আকাশ দাসকে পুলিশ নিয়ে যাওয়ার পর কয়েকশ' লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে দুয়ারাবাজারের হিন্দুদের দোকানপাট, বাড়ি ও মন্দিরে ব্যাপক হামলা চালায়। দুয়ারাবাজার উপজেলা সদরে অবস্থিত কেন্দ্রীয় লোকনাথ মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক খোকন রায় বলেন, "লোকনাথ মন্দিরে ভাংচুর করা হয়েছে। মন্দিরের মালামাল লুট করা হয়েছে। মন্দিরের অন্তত ১৫-২০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৩ শতক জায়গার ওপরের মন্দিরটিতে ব্যাপকভাবে ভাংচুর করা হয়। বাজারে থাকা হিন্দু সম্প্রদায়ের ৫০টিরও বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর করা হয়েছে।”
খোকন রায় আরো জানান, "উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি গুরু দাস দে'র বাড়ি, পারিবারিক মন্দিরসহ আশপাশের আরো বাড়িঘরে লুটপাট করা হয়েছে। এছাড়া উপজেলার মংলাগাঁও গ্রামেও হামলা, ভাংচুর, লুটপাট হয়েছে।”
মংলারগাঁও গ্রামের রাহুল দাস রাতুল হামলার পর তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সিলেট শহরে চলে গেছেন। টেলিফোনে তিনি বলেন," আমার হিসাবে সব মিলিয়ে ১০৫টি বাড়িতে হামলা হয়েছে। মোট ২০-২৫টি মন্দিরে হামলা হয়েছে। এরমধ্যে লোকনাথ মন্দির ছাড়া বাকিগুলো পারিবারিক মন্দির। আমার মতো অনেক পরিবারই ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।”
সুনামগঞ্জ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রাত ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত হামলা ও ভাংচুর হয়েছে। আগে বাজারে এবং বাজার থেকে গিয়ে গ্রামে ভাংচুর, হামলা ও লুটপাট করা হয়। পরে যৌথ বাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আমাদের হিসাবে শতাধিক বাড়ি-ঘর, দোকানপাট ও মন্দিরে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।”
হামলার কোনো মামলা নেই
তবে দুয়ারা বাজার থানার ওসি (তদন্ত) শামসুদ্দিন আহমেদের হিসেবটা একেবারেই ভিন্ন৷ তার দাবি, "তেমন কিছু হয় নাই। একটি মন্দির এবং চার-পাঁচটি বাড়িতে হামলা হয়েছে। দোকানপাটে হামলা হয়নি। যারা শতাধিক বলছে, তারা বাড়িয়ে বলছে।”
তিনি জানান, হামলার ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি৷ ফেসবুক কমেন্টের জন্য আকাশকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার ব্যাপারে তদন্ত চলছে। তবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, ফেসবুক কমেন্টটি তার ফেসবুক আইডি থেকেই করা হয়েছে।”
"এলাকায় পর্যাপ্ত পুলিশ আছে , সেনা সদস্যরা আছেন। পরিস্থিতি এখন শান্ত আছে,” বলেও দাবি করেন তিনি।
দুয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেহের নিগার তনুর কণ্ঠেও যেন দুয়ারা বাজার থানার ওসি (তদন্ত) শামসুদ্দিন আহমেদের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি, "তেমন কিছু হয়নি। আমি ওই এলাকায় গিয়েছি। কয়েকটি বাড়ির বাইরে থেকে হামলা হয়েছে। তবে লুটপাট হয়েছে তা আমি বলবো না। আর একটি মন্দিরে ভাংচুর হয়েছে। এখন পরিস্থিতি শান্ত আছে।”
রাহুল দাস রাতুল অবশ্য বলেছেন, মংলারগাঁও প্রায় জনশূন্য, ভয়ে প্রায় সব মানুষই এই মুহূর্তে গ্রামছাড়া৷