1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জাতিবিদ্বেষ গিলে খাচ্ছে ভারতকে

রাজীব চক্রবর্তী নতুন দিল্লি
২১ জুন ২০১৮

এক ডিশ টিভি গ্রাহকের আর্জি, পরিষেবা দেওয়ার জন্য মুসলিম নয়, হিন্দু প্রতিনিধি পাঠাতে হবে৷ আশ্চর্যজনকভাবে বিদ্বেষমূলক ঐ আর্জি মেনে নিয়ে হিন্দু প্রতিনিধি পাঠাল ডিটিএইচ সংস্থা এয়ারটেল৷ নিন্দার ঝড় বইছে দেশজুড়ে৷

https://p.dw.com/p/300Xn
ছবি: Reuters/UNI

ভারতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ কোন স্তরে পৌঁছেছে বোঝা যায় সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায়৷ মাস খানেক আগে বেঙ্গালুরু শহরে অনলাইন ট্যাক্সি বুক করার সময় শুধুমাত্র ক্যাবের চালক মুসলিম হওয়ার কারণে বুকিং বাতিল করে দিয়েছিলেন এক মহিলা৷ ঠিক বিপরীত একটি ঘটনা ঘটেছে যখন এক ওলা ক্যাবের চালক তাঁর যাত্রীকে তাঁর গন্তব্যে পৌঁছে দিতে অস্বীকার করে বুকিং বাতিল করেছেন৷ কারণ সেই যাত্রী মুসলিম ছিলেন৷ ঐ ঘটনায় সেদিনই সংশ্লিষ্ট ক্যাব কোম্পানি তাদের চালককে বরখাস্ত করেছে৷ এই তালিকায় শেষতম সংযুক্তি হল লখনউয়ে এক হিন্দু-‌মুসলিম দম্পতি তাঁদের পাসপোর্ট পুনর্নবীকরণের আবেদন জানানোর পর সাক্ষাৎকারে তাঁদের ধর্ম পরিবর্তনের পরামর্শ দেন এক কর্মকর্তা৷ সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনা৷ সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল৷ বাধ্য হয়ে ওই আধিকারিককে বদলি করার নির্দেশ দিয়েছেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ৷ এই তালিকায় ডিটিএইচ সংস্থা ভারতী এয়ারটেল এবং তাদের এক গ্রাহকের বিদ্বেষমূলক আচরণ গোটা দেশকে লজ্জিত করেছে৷

এই ঘটনার সূত্রপাত সপ্তাহখানেক আগে৷ উত্তর প্রদেশের লখনউয়ের বাসিন্দা পূজা সিং তাঁর ডিটিএইচ (ডাইরেক্ট টু হোম) পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা এয়ারটেল-‌কে ফোন করে টেলিভিশনে কিছু সমস্যার অভিযোগ জানান এবং একজন প্রতিনিধি পাঠাতে বলেন৷ যথারীতি এয়ারটেলের পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি ঐ মহিলা গ্রাহকের বাড়িতে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ করে আসেন৷ কিন্তু ঐ মহিলা গ্রাহকের অভিযোগ, তাঁর সঙ্গে ‘‌দুর্ব্যবহার’ করেছেন সংস্থার সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার৷ তাঁর টিভিতে আবারও কিছু সমস্যা দেখা দেয়৷ এবার তিনি এয়ারটেলে ফোন করেন এবং সংস্থাটি যাঁকে ঐ গ্রাহকের বাড়িতে পাঠায় তিনিও মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত৷ এবার বেঁকে বসেন পূজা৷ তিনি এয়ারটেল ডিটিএইচ-‌এর ওই প্রতিনিধিকে ফেরৎ যেতে বলেন৷ এবং সংস্থাকে ফোন করে জানান, মুসলিম নয়, বরং কোনো হিন্দুকে তাঁর বাড়িতে পাঠানো হোক৷ এখানেই শেষ নয়, পুরো বিষয়টি ঘটা করে সোশ্যাল মিডিয়া টুইটারে তুলে দেন তিনি৷ এরপর যা ঘটল তা আরও আশ্চর্যজনক৷ পূজা নামের ওই গ্রাহকের ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অন্যায় পূজার দাবি মেনে মুসলিম যুবকের পরিবর্তে একজন হিন্দু সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ারকে তাঁর বাড়িতে পাঠায়৷

এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই সমালোচনার ঝড় ওঠে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে৷ প্রশ্ন ওঠে, একজন গ্রাহক যদি এই ধরনের অন্যায় ও নিন্দাজনক দাবি করেন, তাহলে এয়ারটেলের মতো সংস্থা কীভাবে চুপচাপ সেই দাবি মিটিয়ে দিতে পারে?‌ পূজার পাশাপাশি এয়ারটেলের মুণ্ডপাত হতে থাকে৷ অত্যুৎসাহী কিছু মানুষ তো আবার পূজাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে শুরু করেন৷ পূজার মানসিকতার নিন্দা করলেও তাঁর প্রতি কুৎসিৎ আক্রমণের নিন্দা করেন জম্মু ও কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতা ওমর আবদুল্লাহর মতো অনেকেই৷ সবমিলিয়ে গত কয়েকদিন ধরে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইনস্টাগ্রামে তর্ক-‌বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে গোটা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ৷

‘এটা আসলে ভারতের মিশ্র সংস্কৃতিকে নষ্ট করার চক্রান্ত’

ভারতজুড়ে একের পর এক এই ধরনের ঘটনা বেড়ে চলায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম৷ তিনি সংসদের বিদেশ মন্ত্রক বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য৷ পাসপোর্ট আধিকারিকের ইস্যুতে বিদেশমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন৷ ঐ আধিকারিককে কমিটির বৈঠকে ডেকে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন৷ ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেলিম বলেছেন, ‘‌‘‌আমাদের দেশে মাঝেমধ্যে জাতিগত দাঙ্গা হলেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্তানে বিশ্বাসী৷ এই ভারসাম্য নষ্ট করছে দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি৷’’ অতীতে গুজরাটে এমন ঘটনা দেখা যেত৷ এখন ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দেশে৷ তাঁর কথায়, ‘‌‘‌বাংলাতেও এমন ঘটছে৷ এটা আসলে ভারতের মিশ্র সংস্কৃতিকে নষ্ট করার চক্রান্ত৷ টেলিভিশন চ্যানেলে আরও বেশি করে হিংসা ছড়ানো হচ্ছে৷ কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ এগিয়ে আসছেন৷ হিংসার ঘটনার নিন্দা হচ্ছে৷ মনে রাখতে হবে, এই ধরনের ঘটনা সমূলে উৎখাত না করতে পারলে ভবিষ্যতে ছেলেধরা‌র গুজবের মতো বাড়বে৷’’

এরপর পরিস্থিতি বেগতিক দেখে নিজেদের পক্ষে যুক্তি খাড়া করে বিবৃতি দেয় এয়ারটেল৷ তারা জানায়, ‘‌ভারতী এয়ারটেল’ এই ধরনের জাতি বিদ্বেষমূলক আচরণে প্রশ্রয় দেয় না৷ তারা এমন ধারণার বিরোধী৷ ঘটনাটিকে কাকতালীয় বলে আখ্যা দিয়েছে এয়ারটেল৷ আরও বলা হয়েছে, এয়ারটেল তাদের গ্রাহক, কর্মী বা সহযোগী সংস্থার মধ্যে জাত ও ধর্মের বিভেদ করে না৷ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কর্মী নির্বাচন করা হয়৷ ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে তারা বলেছে, অহেতুক ধর্মীয় রং চড়ানো হচ্ছে৷

যদিও বহু মানুষ তা মানতে চাইছেন না৷ বরং আওয়াজ উঠছে, ওই গ্রাহক এবং এয়ারটেল কর্তৃপক্ষ উভয়েই ধর্মীয় ও জাতিগত শত্রুতার বীজ বপন করেছে৷ তারা উভয়েই সমান ভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে নষ্ট করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে৷ কেউ কেউ তো আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় এয়ারটেলের গ্রাহক পদ ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷ অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় ওয়ার পরেও নিজের পূর্বের অবস্থান থেকে সরতে নারাজ লখনউয়ের ঐ গ্রাহক পূজা৷ একটি টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘‘পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই শুধু হিন্দু ইঞ্জিনিয়ার পাঠানোর অনুরোধ করেছিলাম৷ কিন্তু এর জন্য যেভাবে আমাকে অপদস্থ করা হচ্ছে, তা কখনও আশা করিনি৷ বুঝতে পারছি, আমার সিদ্ধান্ত নির্ভুল ছিল৷’’