সংগীতকে বেঁধে রাখার চেষ্টা
১৯ মার্চ ২০১৭লালন ফকিরের কথা টেনে বলা যায়, জাত দিয়ে কি বিচার হয় সংগীতের? হয় না৷ লালনের গানে যে ঈশ্বর-আল্লাহ একাকার হয়ে গেছে, সে কথা কে না জানে? তাঁর গানের আবেদন অবিনশ্বর৷ কিন্তু বহুত্ববাদী আধুনিক ভারতে সেই সহিষ্ণুতা নিম্নগামী৷
ভারতের দক্ষিণী রাজ্য কর্নাটক৷ সেখানেই বাস করেন ২২ বছরের মুসলিম তরুণী সুহানা সাঈদ৷ এক টিভি চ্যানেলের রিয়্যালিটি সংগীত শো অনুষ্ঠানে হিন্দু দেবতা বালাজির ওপর ভক্তিসংগীত গেয়ে শোনান তিনি৷ প্রতিযোগিতার বিচারকমণ্ডলি তাঁর গায়কির উচ্চ প্রশংসা করে বলেন, হিন্দু ভক্তিগীতি গেয়ে সুহানা হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক প্রতীক হয়ে উঠেছে৷ কিন্তু গত ৪ঠা মার্চ ঐ এপিসোডটি টেলিকাস্ট হবার পর এক শ্রেণির মুসলিম মৌলবাদীরা সুহানার ওপর খড়্গহস্ত৷ ম্যাঙ্গালোর মুসলিম গ্রুপ ফেসবুকে তাঁকে হুমকিও দেয় এই বলে যে, সুহানা এভাবে টিভিতে সকলের সামনে গান গেয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করেছেন৷ অন্য সম্প্রদায়ের প্রশংসা পেয়ে যদি সে ধরাকে সরা জ্ঞান করেন, তাহলে ভুল করেছেন সুহানা৷
এখানেই শেষ নয়৷ সুহানার মা-বাবাকেও ফেসবুকে হুমকি দিতে ছাড়েনি তারা৷ বলা হয়েছে, এভাবে গান গাইতে উৎসাহ দিয়ে মেয়েকে নরকের পথে ঠেলে দিয়েছেন তাঁরা৷ এমনকি, সুহানার হিজাব খুলে নেবার কথাও বলা হয়েছে৷ কারণ সুহানা হিজাব পরেই গানে অংশ নিয়েছিলেন৷ তাই হিজাব পরার অধিকার নাকি হারিয়েছেন তিনি৷ ভারতের মৌলবাদীরা সুহানার সংগীত প্রতিভা উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, যেসব মুসলিম বাচ্চারা ছয় মাসের মধ্যে কোরান পড়া রপ্ত করে তাঁদের কৃতিত্ব হাজার গুণ বেশি৷ সুহানা মুসলিম আর ইসলাম একেশ্বরবাদী৷ অথচ সুহানা বহু ঈশ্বরের ভজনা করেছেন৷ সেটা হতে পারে না৷ বলা বাহুল্য, এ ধরনের হুমকির পর সুহানা এখন ঘরবন্দি৷ কিন্তু গান তো আর ছাড়া যায় না...৷ সংগীত যে তাঁর জীবন৷
প্রসঙ্গত, ম্যাঙ্গালোর ঐ মুসলিম গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার৷
পাশাপাশি পূর্ব-ভারতের আসাম রাজ্যেও ঘটেছে একই ধরনের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ঘটনা৷ ১৬ বছরের কিশোরী নাহিদ আফ্রিনকে নিয়ে সেখানে বিতর্ক শুরু হয়েছে৷ বিষয়টা মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত গড়িয়েছে৷ নাহিদ টেলিভিশন রিয়্যালিটি শো-এর রানার্স-আপ৷ কিছু গোঁড়া মৌলবি হ্যান্ডবিলে ফতোয়া দিয়েছে, মুসলিম মেয়েদের এভাবে টিভিতে বা প্রকাশ্য মঞ্চে গান গাওয়া বন্ধ করতে হবে৷ ইসলাম ধর্মে এটা পাপ৷ সেই থেকে নাহিদ সমানে চোখের জল ফেলছে৷ বলছে গানই তাঁর ধ্যানজ্ঞান৷ তাই গান সে ছাড়তে পারবে না, তা তারজন্য যে মূল্যই দিতে হোক না কেন৷ এ অবস্থায় তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সরকার ও নাগরিক সমাজ৷ আসামের মন্ত্রী এ বিধায়করা নাহিদের বাড়িতে গিয়ে তাকে অভয়ও দিয়ে এসেছেন৷ মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল ফোনে আশ্বায় দিয়ে বলেছেন, সরকার তার পাশে আছে৷ আর তারপরেই আসামের মুসলিম পার্সোনাল ল-বোর্ড থেকে বলা হয়েছে নাহিদকে ফতোয়া দেয়া হয়নি, স্রেফ হ্যান্ডবিলে আবেদন করা হয়েছে৷
এমন অসহিষ্ণুতার উদাহরণ ভারতে ভুরি ভুরি৷ শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনকে দেবি সরস্বতীর আপত্তিকর ছবি আঁকার কথিত অপরাধে দেশছাড়া হতে হয়েছিল একদিন৷ হালে বলিউড চিত্রনির্মাতা সঞ্জয় লীলা বানসালিকে চিতোরের রাণী পদ্মাবতীর কাহিনি অবলম্বনে ছবি করতে বাধা দেয়া হয়৷ সেটে ভাঙচুর চালায় মৌলবাদী হিন্দু সংগঠনের কিছু সদস্য৷ অভিযোগ, দ্বাদশ শতাব্দিতে রাজরাণী পদ্মাবতীকে নাকি দেবী হিসেবে নয়, অতি সাধারণ মানবী হিসেবে ছবিতে দেখাতে চেয়েছেন চিত্রপরিচালক৷
এদিকে অন্য সব সম্প্রদায়ে মানুষ সুহানার সমর্থনে এগিয়ে এসে বলেছে, মুসলিম অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যখন সিনেমায় হিন্দু দেব-দেবীর চরিত্রে অভিনয় করেন, তখন তো তাঁরা চুপ থাকে৷ হৈ চৈ করে না৷ বিখ্যাত পরভিন সুলতানা, মহম্মদ রফির মতো বহু মুসলিম সংগীত শিল্পীদের হিন্দু ভক্তিগীতি ও ভজনের বহু রেকর্ড আছে৷ খ্রিষ্টান সংগীত শিল্পী জেসুদাস সবরিমালা মন্দিরে ভগবান আয়েপ্পার বন্দনা গান গেয়েছেন৷ হিন্দু জগজিত সিং ও কিশোর কুমার বহু মুসলিম ভক্তিগীতি গেয়েছেন৷ হিন্দু-মুসলিম সবাই বড়দিনে খ্রিষ্টান ভক্তিগীতি ‘ক্যারল' গেয়ে থাকেন৷ পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেতারগুরু ছিলেন পণ্ডিত আলাউদ্দিন খান৷ খাজা মইনুদ্দীন চিস্তি মিশ্র সংস্কৃতির সংগীত ও নৃত্যের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন ভক্তিগীতি এবং সুফি আধ্যাত্মবাদ৷ আরও নজির আছে৷ পাকিস্তানের সুফি রক ব্যান্ড জুনুন-এর প্রতিষ্ঠাতা পাকিস্তানের সলমন আহমেদ বলেন, সংগীত বিশ্বকে জোড়ে, ভাগ করে না৷ তারপরও এই ধরনের মৌলবাদী অসহিষ্ণুতা ক্রমশই বিপদ বাড়াচ্ছে৷ এইসব তালিবানের হাত থেকে সুহানা বা নাহিদের মতো গায়িকাদের পাশে দাঁড়াবার সময় এসেছে৷ কাজেই সোশ্যাল মিডিয়ায় যাঁরা সুহানার নিন্দা করছেন, তাঁদের বোঝা উচিত যে ইসলাম এক মহান ধর্ম৷ বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছে সুহানা৷ এতে দোষের কী আছে? সংগীতের যে কোনো ধর্মীয় বেড়া থাকতে পারে না৷
তবে সবথেকে নজর কেড়েছে ওড়িষার কেন্দ্রপাড়ায় ছ'বছরের এক মুসলিম বালিকা ফিরদৌস৷ গত সপ্তাহে এক মন্দির প্রাঙ্গনে স্তোত্রপাঠ প্রতিযোগিতায় ৪৬ জন প্রতিযোগীর মধ্যে প্রথম হয়েছে সে৷ পেয়েছে ১০০ নম্বরের মধ্যে সাড়ে ৯৭৷ প্রথম শ্রেণির এই খুদে পড়ুয়া ফিরদৌস গডগড় করে মুখস্থ বলে গেল হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ভগবত গীতার শ্লোক৷ সকলেই বিস্ময়ে হতবাক৷ কারণ ফিরদৌসের এখনও ভালো করে অক্ষরজ্ঞান হয়নি৷ স্কুলের প্রার্থনায় শুনে শুনে সে শুধু মুখস্থ করেছে৷ গীতার শ্লোক আবৃত্তি করার সময় সারাক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে সাহস জুগিয়ে গেছেন ফিরদৌসের মা আরিফা বিবি৷ পরিবেশের সংবেদনশীলতা বুঝে অবশ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছিল প্রশাসন৷
বন্ধু, আপনার কী মত? সংগীতকে কি কোনো ধর্মীয় বেড়া দিয়ে বেঁধে রাখা সম্ভব? লিখুন নীচের ঘরে৷