ধর্ষণ কমাতে যৌন শিক্ষাও বাড়ানো হোক
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০জার্মানির কথাই আগে বলি৷ ২০১৫ সালে সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য দুয়ার খুলে দেয় ইউরোপের দেশটি৷ তখন শুধু সিরিয়া নয়, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশ থেকেও অনেক শরণার্থী জার্মানিতে প্রবেশ করে৷ সংখ্যাটি অন্তত দশ লাখ৷
এই বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী আসার পর জার্মানিতে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার নানা খবর শোনা গেছে৷ আর সেসব ধর্ষণের পেছনে কখনো কখনো অভিবাসীদের জড়িত থাকার বিষয়টিও গণমাধ্যমে আসতে থাকে৷ অভিবাসীদের সম্পর্কে অনেক জার্মানের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির একটি কারণও এসব ধর্ষণের অভিযোগ৷
জার্মানি তখন ধর্ষণের ঘটনা রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি আরেকটি উদ্যোগ নিয়েছিল৷ অভিবাসীদের যৌন শিক্ষা দিতে একটি বিশেষ ওয়েবসাইট চালু করা হয়েছিল জার্মান সরকারের অর্থায়নে৷ সাইটটির ভাষা হিসেবে জার্মান, ইংরেজির পাশাপাশি আরবি, তুর্কিসহ এমন কিছু ভাষা রাখা হয়েছিল, যেসব ভাষাভাষী অঞ্চল থেকে প্রচুর অভিবাসী জার্মানিতে আসে৷
যৌন শিক্ষা বিষয়ক ওয়েবসাইটে নারী-পুরুষের শরীর, যৌনতা, পরিবার, গর্ভধারণ বিষয়ক নানা তথ্য ছবিসহ দেয়ার পাশাপাশি পরষ্পরের মধ্যে সম্পর্ক, সম্মতি, আইনি অধিকারের বিষয়াদিও ভালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে৷ বলা যেতে পারে একজন মানুষের যৌন শিক্ষা বিষয়ক যেসব তথ্য জানা দরকার, সবই সেখানে রয়েছে৷ যৌন শিক্ষা জার্মানির স্কুলে অনেক আগে থেকেই দেয়া হয়৷ এই ওয়েবসাইট সেখানে যুক্ত হয়েছে অভিবাসীদের জন্য যাতে তারাও বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পায়৷
অথচ, আমাদের দেশের পরিস্থিতি কিন্তু এখনো অনেকটাই ভিন্ন৷ অভিবাসী দূরে থাক, দেশটির সাধারণ মানুষেরই যৌন শিক্ষা পাওয়ার কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই৷ বরং এটা এমন এক নিষিদ্ধ বিষয় যে, এই নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষক কাউকে প্রশ্ন করাই যেন এক অপরাধ৷ মনে আছে, উচ্চ মাধ্যমিকের জীববিজ্ঞান বইতে মানুষের জননাঙ্গ সম্পর্কে একটি অধ্যায় ছিল৷ সেখান থেকে পরীক্ষায় প্রশ্ন আসতো বটে, তবে সেই অধ্যায় শিক্ষকরা ক্লাসে বা প্রাইভেট টিউশনিতে পড়াতেন না৷ বলতেন নিজে নিজে শিখে নিতে৷
গত শতকের শেষের দিকে বা বর্তমান শতাব্দির শুরুর দশকেও আমাদের সমাজে কিশোর-কিশোরী বা যুবক-যুবতীদের যৌনতা বিষয়ক জ্ঞান পাওয়ার মূল উৎস আসলে ছিল ‘ব্লুফিল্ম’৷ অবাস্তব, অস্বাভাবিক সেসব ফিল্ম দেখে যৌনতা বিষয়ক যে জ্ঞান তাদের হয়, তাতে আর যা-ই হোক ধর্ষণ, সম্মতি, স্বাভাবিক যৌন জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া কঠিন৷ বরং মনে হতে পারে, যৌন সঙ্গম হচ্ছে নারীর উপর কর্তৃত্ব খাটাতে পুরুষের এক অবলম্বন৷ আর এক্ষেত্রে জোর খাটানোটা যেন পুরুষত্বের বহিঃপ্রকাশ৷
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বাংলাদেশে যৌনশিক্ষা চালুর নানা কথা শোনা যাচ্ছে৷ তবে, সেটার পরিধি যে খুব সীমিত সেটা বোঝাই যায়৷ বরং নিকট অতীতে দেখেছি সম্মতি বিষয়ক এক ভিডিও মুছে ফেলা হয়েছে একটি জনপ্রিয় শিক্ষা বিষয়ক প্ল্যাটফর্ম থেকে৷ সেটা না করলে প্ল্যাটফর্মটির মালিককে হত্যার হুমকি দিয়েছিল ধর্মান্ধরা৷
যৌন শিক্ষা ধর্ষণ প্রতিরোধে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে সেটা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের নানারকম মন্তব্য রয়েছে৷ আমি মনে করি, ধর্ষণরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ আর নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি যৌন শিক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে৷ মানুষের যৌনাঙ্গ, যৌনতা, সম্মতি, সম্পর্কের বিষয়ে আমাদের দেশের মানুষের প্রকৃত জ্ঞান জরুরি৷ আর এসব জানলে অনেক ভ্রান্ত ধারণা এমনিতেই ঘুঁচে যাবে, কমবে নারী-পুরুষের মধ্যকার মানসিক দূরত্ব৷
২০১৮ সালের জুলাইয়ের ছবিঘরটি দেখুন...