ধর্ষণ মামলায় আওয়ামী লীগ এমপির বড় ভাই এবং রাজনীতি
১০ এপ্রিল ২০২৩টাঙ্গাইলে শহর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গোলাম কিবরিয়া ওরফে বড় মনি আর তার ছোট ভাই তানভীর হাসান ছোট মনির টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। এমপির বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে। এক কিশোরীকে ( ১৭) ধর্ষণের অভিযোগে টাঙ্গাইল সদর থানায় বুধবার রাতে মামলাটি করা হয়। পুলিশ এখনো বড় মনিকে গ্রেপ্তার না করলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কোন্দল চরমে উঠেছে। ছোট ভাই ছোট মনির এখন চাপে পড়েছেন তার নির্বাচনী এলাকায় বড় ভাইয়ের কারণে। দলের ভিতরে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এই ধর্ষণকে কেন্দ্র করে মাঠে নেমেছেন। বসে নেই ছোট মনিরও। তিনিও তার পক্ষের লোকজনকে মাঠে নামিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব যখন পরস্পরের মুখোমুখি, তখনই ধর্ষণের শিকার ওই কিশোরী বলেছেন, রাজনীতি নয়, তিনি চান ন্যায়বিচার।
জানা গেছে, ধর্ষণের বিচার দাবিতে শনিবার ভূঞাপুর উপজেলা সদরে ঝাড়ু–মিছিল করেছেন দুই শতাধিক নারী। শুক্রবার সকালে টাঙ্গাইল শহরেও নারীদের বিক্ষোভ মিছিল হয় ‘সচেতন নারী সমাজ'-এর ব্যানারে।
আর টাঙ্গাইল শহরে ‘সচেতন নারী সমাজের' নামে পোস্টার লাগানো হয়েছে ধর্ষণের বিচার দাবি করে। ওই পোস্টারে বড় মনিকে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়েছে।
এদিকে এমপি ছোট মনিরের পক্ষে শনিবার টাঙ্গাইল শহরে সচেতন ‘নাগরিক সমাজের’ ব্যানারে মিছিল হয়েছে। মিছিল থেকে মনিরের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্রকারীদের’ হুশিয়ার করা হয়েছে। আর রবিবার একই ব্যানারে ভূঞাপুরে মনিরের পক্ষে মিছিল হয়েছে।
টাঙ্গাইল জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায়ও রবিবার সংসদ সদস্যের ভাইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলাটি নিয়ে কথা হয়। সভায় কয়েকজন সংসদ সদস্যের ভাইয়ের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো. শরফুদ্দীন মামলার তদন্ত এবং আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান।
টাঙ্গাইল শহর এবং গোপালপুর-ভূঞাপুর এলাকায় এখন এমপির ভাইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলাই প্রধান আলোচনার বিষয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ এই ঘটনা নিয়ে দুই ভাগ হয়ে পড়েছে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ তাই বিভক্তি চরম আকার ধারণ করেছে। ধর্ষণের শিকার কিশোরীর বিচারের চেয়ে কে কাকে ঘায়েল করবে সেটাই যেন তাদের প্রধান লক্ষ্য।
ভূঞাপুরে সংসদ সদস্য মনিরের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পৌর মেয়র মাসুদুল হক। তিনি বলেন, ‘‘আমরা সংসদ সদস্যের বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা নিয়ে খুবই বিব্রত। সবাই ছি ছি করছেন। এটা আমাদের দলের জন্যও অস্বস্তিকর। এলাকার মানুষ ধিক্কার দিচ্ছে। ন্যাক্কারজনক কাজ।”
তিনি বলেন, "সাধারণ মানুষ এবং নারী সমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, বিচার দাবি করছেন। আমরাও দাবি করি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিলে তো জেলা কমিটিকে নিতে হবে। তার ভাই (ছোট মনির) আবার জেলা কমিটির নেতা। ব্যবস্থা কি নিতে পারবে!”
তার কথা ,‘‘ছোট মনির হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। এখানকার রাজনীতিতে তার অতীত কোনো কাজ নেই। হঠাৎ করেই এমপি হয়েছেন। তাই দলের মর্যাদার কী বুঝবেন? ”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘তার ভাই তো পলাতক। পুলিশ চেষ্টা করছে তাকে গ্রেপ্তারের। তবে শুনেছি তিনি এরই মধ্যে দেশের বাইরে চলে গেছেন। আর এমপি সাহেবও ঢাকায় আছেন।”
অন্যদিকে এমপি ছোট মনির দাবি করেন, ‘‘ধর্ষণের মামলাটি মিথ্যা। আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তাকে দিয়ে মামলাটি করিয়েছে। ওই মেয়েটি আমাদের আত্মীয়। তার মা-বাবা নেই। আমার ভাবী তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এখন আমাদের প্রতিপক্ষই তাকে কাজে লাগাচ্ছে। সামনে আমার জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ আবার আমার ছোট ভাই জেলা যুবলীগের সভাপতি প্রার্থী। সব মিলিয়ে আমাদের ঘায়েল করার জন্য এসব করা হচ্ছে।”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘মামলার তদন্ত হচ্ছে। অবশ্যই আমার ভাই এটাকে আইনগভাবে মোকাবিলা করবেন। তিনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, তার মামলা তিনিই দেখবেন। সময় হলে আদালতে আত্মসমর্পণও করবেন। আমি মামলার ব্যাপারে প্রশাসনের কারো সঙ্গে কোনো কথাও বলিনি। তারপও আমাকেই কেন টার্গেট করা হচ্ছে!”
মামলায় যা বলা হয়েছে
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে,গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল শহরের আদালত পাড়ায় নিজের বাড়ির পাশের একটি ভবনে ওই কিশোরীকে ডেকে নেন বড় মনি। সেখানে তার মুঠোফোন ছিনিয়ে নিয়ে তাকে একটি কক্ষে আটকে রাখেন। পরে তাকে ধর্ষণ করে তার আপত্তিকর ছবি তুলে রাখা হয়। বিষয়টি কাউকে না বলার জন্য তাকে ভয়ভীতি দেখান তিনি।
এরপর আপত্তিকর ওই ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেখিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
এক পর্যায়ে ওই কিশোরী অন্তঃস্বত্তা হয়ে পড়েন। বিষয়টি জানার পর গর্ভের সন্তান নষ্ট করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিশোরী রাজি না হওয়ায় গত ২৯ মার্চ রাত আটটার দিকে বড় মনির ওই কিশোরী তুলে নিয়ে আদালত পাড়ার একটি বাড়িতে যান। সেখানে একটি কক্ষে তাকে তালাবদ্ধ করে রেখে বড় মনির আবার ধর্ষণ করেন। এই ঘটনার পর বড় মনিরের স্ত্রী নিগার আফতাব কিশোরীকে মারধর করেন। পরে দিবাগত রাত তিনটার দিকে ওই কিশোরীকে বাড়িতে রেখে আসা হয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ থাকার জন্য মামলা করতে দেরি হয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
কিশোরী যা বললেন
ধর্ষণের শিকার ওই কিশোরী বলেন, ‘‘তারা আমার আত্মীয়, কিন্তু তাদের বাড়িতে আমি থাকতাম না। শুধু আমি একা নই, আরো অনেক নারী তার ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আমি নিজে তা জানি। আমি চাই আর যেন কোনো নারী এই পরিস্থিতির শিকার না হন। এজন্যই আমি মামলা করেছি। আমি ন্যায়বিচার চাই। আশা করি ন্যায়বিচার পাবে।”
তিনি বলেন, ‘‘মামলার পর আমার জবানবন্দি নেয়া হয়েছে এবং ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে মামলা আদালতে যাওয়ার পর আমি আবার ডাক্তারি পরীক্ষার আবেদন করবো। শারীরিকভাবে আমি এখন খুবই অসুস্থ। আমি এখনো কোনো চাপের মুখে নাই। তবে ভবিষ্যতে কী হয় জানি না। ”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমি রাজনীতি করি না। যারা এটা নিয়ে রাজনীতি করছেন সেটা তাদের ব্যাপার। আমি চাই ন্যায়বিচার।”
এদিকে টাঙ্গাইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আ. ছালাম মিয়া জানান,‘‘মামলার তদন্ত ও আসামিকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। আমরা মামলা নেয়ার পর ভিকটিমের জবানবন্দি, ডাক্তারি পরীক্ষা শেষ করে তাকে আদালতের মাধ্যমে তার ফুপুর জিম্মায় দিয়েছি। তার নিরাপত্তার দিকে আমরা খেয়াল রাখছি।” তিনি জানান, ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন তারা এখনো পাননি। তবে দুই-একদিনের মধ্যে পেয়ে যাবেন।
ধর্ষণের শিকার কিশোরীর বাবা-মা দুই জনই কয়েক বছর আগে মারা গেছেন।