‘ধর্ষণে মেয়েদের দায় বেশি’
২২ নভেম্বর ২০১৪বাংলাদেশ পুলিশের এক কর্মকর্তার দাবি করেছেন, ধর্ষণের দায় প্রধানত নারীদের৷ বখাটেরা তো ঘোরাফেরা করবেই৷ ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ মনে করেন, পুলিশ কর্মকর্তার এই কথায় আবারো ধর্ষণের ব্যাপারে মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনা ফুটে উঠেছে৷ আর ধর্ষকরা নতুন করে উত্সাহিত হলে বলার কিছু থাকবে না৷ তাঁর ব্লগ পোস্ট৷
সিলেটে গণধর্ষণের শিকার এক নারীকে নিয়ে একটি সরেজমিন ভিডিও প্রতিবেদন করেছে মার্কিন টিভি চ্যানেল ‘ভাইস নিউজ৷' আর সেই প্রতিবেদনেই দেখানো হয়েছে ধর্ষণ নিয়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তার মন্তব্য৷ তিনি দু'দফায় একই ধরনের মন্তব্য করেন৷
সিলেটের সুনামগঞ্জের ছাতক থানার ওই কর্মকর্তা সাংবাদিক তানিয়া রশিদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘অবৈধ মেলামেশা এবং প্রেমের কারণে নারীর ধর্ষণের শিকার হন৷ তারা অধিকাংশ সময়ই সমঝোতার ভিত্তিতেই মিলিত হন৷ পরে জানাজানি হয়ে গেলে সামাজিক কারণে মামলা করেন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘মেয়েরা যদি আরেকটু পর্দানশিন হন, বেপরোয়াভাবে চলাফেরা না করেন তাহলে ধর্ষণের পরিমান কমে আসবে৷'' ওই পুলিশ কর্মকর্তার মতে, ধর্ষণের ঘটনায় মেয়েদের দায়ই বেশি৷ যারা বেপরোয়া এবং বেপর্দায় চলাফেলা করেন তারাই ধর্ষণের শিকার হন৷ বখাটেরা, অপরাধীরাতো ঘোরাফেরা করবেই৷''
পুলিশ কর্মকর্তার নাম পরিচয় দেয়া হয়নি প্রতিবেদনে৷ তবে তিনি ইউনিফর্মে একবার গড়ির ভিতরে চলন্ত অবস্থায় এবং আরেকবার ছাতক থানায় বসে দু'দফায় একই ধরনের কথা বলেন৷
প্রতিবেদনে দু'জন ধর্ষকেরও সাক্ষাত্কার দেখানো হয়েছে মুখ ঢেকে৷ যারা তাদের ধর্ষণের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন৷ তবে এখন অনুতপ্ত৷ আর ধর্ষিতাকে দেখানো হয়েছে স্পষ্টভাবেই৷ তার বাড়ি থেকে শুরু করে তাঁর সাক্ষাত্কার সবকিছুই৷ আর ২০ মিনিটের এই প্রতিবেদনটি শুরুই হয়েছে ধর্ষিতা নারী এবং তার বক্তব্য দেখিয়ে৷ যেখানে ধর্ষিতা তাঁকে ধর্ষণের বর্ণনা দিয়েছে৷
প্রথমেই আসা যাক পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্যে৷ তিনি ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাকে দায়ী করে তার মধ্যযুগীয় চিন্তা চেতনারই প্রকাশ ঘটিয়েছেন৷ তাঁর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে বাংলাদেশে কোন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে বিচার চাইতে গেলে কী ধরনের নির্মমতা এবং হয়রানির শিকার হন৷ প্রতি পদে পদে তাকে নতুন করে ধর্ষণ করা হয়৷ পুলিশ তদন্তের শুরুতেই ধর্ষিতাকে দায়ী করতে থাকে৷ আর ধর্ষক তখন স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়৷ এরপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাকে প্রমাণ করতে হয় যে সে ধর্ষিতা৷ তার ডাক্তারি পরীক্ষা থেকে শুরু করে সবখানেই হয়রানি৷ এমনকি পরিবারের পক্ষ থেকেও ধর্ষিতাকে দায়ী করা হয়৷ আর প্রত্যন্ত অঞ্চলে হলে তো কথাই নেই৷ সমাজপতি বা ধর্মীয় নেতারা নারীকে দায়ী করে সালিশের মাধ্যমে ফয়সালা করেন থানা পর্যন্ত যেতে দেন না৷ আর কেউ কেউ সামাজিক চাপ এবং হয়রানির ভয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েও চুপ থাকেন৷
চুপ না থেকে উপায় কী? পুলিশেরই যদি এই মনোভাব হয় তাহলে আর থানায় গিয়ে লাভ কী৷ বাংলাদেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর আইন আছে৷ এই অপরাধে মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে৷ কিন্তু সেই আইন যারা কার্যকর করবেন, যারা তদন্ত করবেন, বিচারের জন্য মামলাটিকে প্রস্তুত করবেন তারাই যদি ধর্ষকদের পক্ষ নেন তাহলে কীভাবে ধর্ষিতা বিচার পাবেন৷ দিনাজপুরের ইয়াসমীনের কথা এখনো আমাদের মনে আছে৷ সেখানে রক্ষক পুলিশই ভক্ষক হয়েছিল৷ ধর্ষণের পর তাকে পতিতা বানানো হয়েছিল৷ ইয়াসমীন জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছে, ধর্ষকরা কত শক্তিশালী৷
বাংলাদেশে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও ঘটছে এবং তার সংখ্যাও কম না৷ জাতীয় মহিলা পরিষদের জরিপ অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ছ'মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষনের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ এ সময়কালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৫ জনকে৷ এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন আরও ৫১ জন৷
আর জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালে সারা দেশে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়৷ অপহরণ করে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়েছে৷
এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট যে বাংলাদেশে ধর্ষণ বাড়ছে৷ ভাইস নিউজকে সাক্ষাৎকার দেয়া সিলেটের পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন, ‘‘এর জন্য নারী এবং নারীর বেপরোয়া ও বেপর্দা চলাফেরা দায়ী৷'' তবে আমি মনে করি এরজন্য পুলিশের এই মানসিকতাই প্রধানত দায়ী৷ এবং এই মানসিকতার যদি পরিবর্তন না হয় তাহলে ধর্ষকরা আরো উত্সাহিত হবে৷
পুলিশের মনে রাখা, উচিত তাদের কাজ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারে সোপর্দ করা, তাদের অপরাধে উত্সাহিত করা নয়৷ আর স্বাধীনভাবে চলাফেলা করা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার৷ সেটা তাদের নিশ্চিত করা আইনি দায়িত্ব৷ এই দায়িত্ব পালনের জন্যই জনগণের পয়সায় তাদের বেতন দেয়া হয়৷
এবার আসি ‘ভাইস নিউজ' এর প্রতিবেদনের আরো কিছু দিক নিয়ে৷ প্রতিবেদক তানিয়া রশীদ কেন ধর্ষিতা নারীর সরাসরি ছবি দেখালেন আর কেনো পরিচয় প্রকাশ করলেন তা আমার কাছে পরিস্কার নয়৷ আর প্রতিবেদনটি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় করা হয়েছে বলেই আমার ধারণা৷
বাংলাদেশের আইনে ধর্ষিতার ছবি বা তাঁর নাম ঠিকানা প্রকাশ করা বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ তবে ধর্ষিতা যদি স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে চান বা প্রতিবাদ জানাতে চান তাহলে আলাদা কথা৷ কিন্তু ধর্ষিতাকে অবশ্যই জানাতে হবে তাঁর ছবি প্রকাশ হলে তাঁর কোনো ক্ষতি হতে পারে কী না তা৷ আর আইনে ছবি বা নাম পরিচয় কেনো প্রকাশে বাধা আছে তাও বলতে হবে৷ ভাইস নিউজের প্রতিবেদনের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি যে নারী স্বেচ্ছায় তাঁর ছবি ও নাম পরিচয় প্রকাশ করেছেন৷
তারপরও এই প্রতিবেদনটি আরো একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশে ধর্ষিতারা কতটা অসহায়৷ আর ধর্ষকরা কতটা নিরাপদ৷ এখানে পুলিশ কীভাবে ধর্ষণকে উত্সাহিত করে৷