গ্লানি শেষ হয় না
২৬ অক্টোবর ২০১৪ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এমন প্রেক্ষাপটে ধর্ষিতা ও নিগৃহীতা নারীর মেডিক্যাল পরীক্ষাকে সম্মানজনক ও সংবেদনশীল করে তুলতে নতুন নির্দেশিকা জারি করেছে৷ গোটা দেশে তা কার্যকর হবে৷ এই প্রসঙ্গে অন্য একটা প্রশ্ন নতুন করে উঠে এসেছে৷ ধর্ষিতা নারীকে সমাজের প্রতিটি স্তরে যে মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয় সেটা কি বন্ধ করা যায় না? পুলিশ থেকে আরম্ভ করে গোটা সমাজ ধর্ষিতার দিকেই প্রথমে আঙুল তোলে৷ ধর্ষিতা বা নিগৃহীতা নারীকে এমন সব প্রশ্ন এবং পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, যে তাতে তাঁর লজ্জা, অপমান, গ্লানি ও অবসাদের মাত্রা বেড়ো যায় বহুগুণ৷ এমন ঘটনা বিরল নয়, যেখানে সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে পেরে ধর্ষিতাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়৷ অথচ আমাদের সমাজ এমনই, কেউ তাঁকে সাহস জোগাতে মানসিক শক্তি জোগাতে এগিয়ে আসে না৷ পুনর্বাসনের কথা বলে না, রাতারাতি সমাজ তাঁকে ব্রাত্য ঘোষণা করে দেয়৷
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের সহায়তায় তৈরি নতুন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ধর্ষিতা নারীর মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য রাখা হবে আলাদা ঘর৷ ডাক্তারি পরীক্ষার সময় হামেশাই হাসপাতালে এমন এক অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে ডাক্তার থেকে আরম্ভ করে হাজারটা কৌতূহলী চোখ পরীক্ষার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ তাই ঠিক হয়েছে ডাক্তার পুরুষ হলে তাঁর সঙ্গে থাকবেন একজন মহিলা কর্মী বা নার্স৷ নিষিদ্ধ করা হয়েছে টু-ফিঙ্গার টেস্ট৷ সেটা হলো মহিলাদের যোনিমুখে আঙুল ঢুকিয়ে দেখা হয়, তাঁর সতীচ্ছদ বা হাইমেন অক্ষত আছে কি না৷ তা থেকেই বোঝা যাবে সে ধর্ষিতা হয়েছে কি না৷ কিন্তু এটা তো অবাস্তব বলে আমার মতো অনেকেরই মনে হয়৷ ডাক্তারদের অনেকের মতে সতীচ্ছদ ছিন্ন হতে পারে নানা কারণে৷ দ্বিতীয়ত বিবাহিতা মহিলা ধর্ষিতা হলে টু-ফিঙ্গার পরীক্ষায় কি তা প্রমাণিত হবে? বরং শারীরিক পরীক্ষার নামে দফায় দফায় আরো বেশি লজ্জা ও যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়৷
আসলে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিটীই বিচিত্র৷ প্রত্যেকেই নিজের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ধর্ষণকান্ডের কাটা-ছেঁড়া করতে ভালবাসি৷ তার ফাঁক গলে পার পেয়ে যায় প্রকৃত অপরাধী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে৷ এক এক সময় তাই মনে হয়৷ বিশেষ করে ভারতীয় সমাজে মেয়ে হয়ে জন্মানো যেন একটা পাপ৷ কারণ জন্ম থেকে কিংবা ভূমিষ্ঠ হবার আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় মেয়েদের জীবন যন্ত্রণা৷ কন্যাভ্রূণ হত্যা থেকে শুরু করে লিঙ্গ-বৈষম্যের বলি হতে হয় জীবনের প্রতিটি পর্বে৷ দেহ ভোগ করতে না দিলে বান্ধবীর মুখে অ্যাসিড ছুড়ে মুখ বিকৃত করে প্রতিহিংসা মেটায় তাঁর ছেলে বন্ধু৷ বিয়েতে যথেষ্ট যৌতুক না দিলে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয় মেয়েটির স্বামী ও শ্বশুড়বাড়ির লোকজন, সতীদাহের নবতম সংস্করণ৷
আইন আছে, প্রশাসন আছে, পুলিশ আছে, কিন্তু তাতে কিছু আটকায় না৷ অথচ পরিহাস বলে মনে হয় যখন দেখি ভারতীয় সমাজে নারীকে বসানো হয়েছে দেবীর আসনে৷ পূজা করা হয় দেবী শক্তির৷ যেখানেই যাই দেখি অন্তত ১০টা মন্দিরের মধ্যে সাতটা মন্দিরেই প্রতিষ্ঠিত আছে দেবী মূর্তি৷ সকাল সন্ধ্যায় ধুপ ধুনো, ফুল বেলপাতা দিয়ে পুজোর পর প্রসাদ বিতরণ করা হয়৷ আর জীবন্ত দেবী পড়ে থাকে ঘরের কোণে অনাদরে বেশিরভাগ সংসারে৷ তখন নারী অধিকার, নারী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতাকে মনে হয় কথার কথা৷ হাতে গুণে বলা যায় ভারতে কতজন ধর্ষকের শাস্তি হয়েছে৷ হয়ত এমনটাতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি৷