নতুন বছরে ভারতের চিত্রনাট্য
১ জানুয়ারি ২০১৬২০১৬ সালে ভারতের জাতীয় রাজনীতি রাতারাতি সাবালক হয়ে উঠবে – এমনটা কোনো অর্বাচীনও আশা করবে না৷ বরং সংসদের ভেতরে ও বাইরে দলীয় রাজনীতি নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুড়ির ধারাবাহিকতা চলবে৷ অতীত অভিজ্ঞতার সূত্র থেকে বলা যায়, সংসদের অধিবেশন অচল করার নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না বিরোধি দলগুলি৷ গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থ ইস্যুগুলি পড়ে থাকবে বাক্সবন্দি হয়ে৷ উন্নয়নের কোনো বড় পদক্ষেপ নিতে বাধা আসবে প্রতিপদে৷ যেমন জমি অধিগ্রহণ বিল, পণ্য ও পরিষেবা কর, শ্রমিক আইন সংশোধন ইত্যাদি৷ অর্থাৎ আর্থিক সংস্কার থমকে যাবার সম্ভাবনা আছে, যেটা দিল্লি ও বিহার বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবির পর বেশ বড় রকম ধাক্কা খেয়েছে৷ এটা কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কৌশলের ওপর৷ পাশাপাশি কয়েকটি রাজ্যে আসন্ন বিধানসভা ভোটের মুখে কেন্দ্র ও অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাড়বে দলীয় কোন্দল৷ চলতে থাকবে অভিযোগ ও পাল্টা-অভিযোগের কাজিয়া৷ আগামী ফেব্রুয়ারির বাজেট অধিবেশন হবে মোদী সরকারের অর্থনৈতিক অগ্নিপরীক্ষা৷ মনে করা হচ্ছে, এ বছরের বাজেটে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, কর্ম সংস্থান, পরিকাঠামো ও শিল্পায়ন ছাড়া বিশেষ জোর দেয়া হবে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক এবং সেচ তথা কৃষি বিকাশের ওপর৷ বিশ্ব আর্থিক সংকটের চাপে প্রবৃদ্ধির উচ্চহার প্রভাবিত হবে৷ সরকারের তরফে প্রবৃদ্ধির উচ্চহার এবং সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান ফলাও করে তুলে ধরা হলেও, সাধারণ মানুষের জীবনে তার ভূমিগত বাস্তবতা নিয়ে থাকবে প্রশ্ন৷
সামাজিক ইস্যু
আশা করা যায়, গোমাংস নিয়ে দাদরি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না৷ মোদী স্বয়ং বুঝেছেন, এতে তাঁর লাভের চেয়ে লোকসান হয়েছে বেশি৷ উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা রুখতে এবং মৌল হিন্দুত্ববাদীদের মোকাবিলা করতে মোদী আরও কড়া হতে বাধ্য৷ সন্ত্রাসের পাশাপাশি আরও একটা নতুন সংকট ভারতে মাথা তুলছে৷ শুরু হয়েছে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর জন্য ভারত থেকে তরুণ মুসলিম যুবকদের ভাড়া নেয়া৷ এর জন্য চলেছে জোর মগজ ধোলাই কর্মসূচি৷ কয়েকজনকে ধরা পড়েছে ঠিকই, কিন্তু এতে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না৷ বরং সরকারকে সজাগ থাকতে হবে৷ অঙ্কুরে বিনাশ করতে হবে৷ না পারলে আরও বড় বিপদ আসতে পারে৷ অন্যদিকে অযোধ্যায় আবারো রাম মন্দির নির্মাণের যে তোড়জোড় চলছে, সেটা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরিকে জাগানোর নামান্তর৷ কে বলতে পারে, আর একটা বাবরি মসজিদ কাণ্ড হবে না? এছাড়া নতুন বছরে পরিবেশ দূষণ রোধ মোদী সরকারের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ৷ প্যারিস বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত খসড়া চুক্তিতে ভারত সই করলেও, ভারতের শিল্পায়নের কথা মাথায় রেখে কার্বন-নির্গমন নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব হবে, বলা কঠিন৷
দুর্নীতি
নতুন বছরে দুর্নীতি দূর করা সম্ভব হবে, এমনটা আশা করা আকাশকুসুম৷ হয়ত ইতরবিশেষ হলেও হতে পারে৷ কারণ মোদী সরকার নতুন বছরে ব্যাপকমাত্রায় শুরু করতে চলেছেন ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া', যার অঙ্গ হিসেবে ই-গভর্নেন্স, টুইটার, অ্যাপ, ই-ট্রেড, মোবাইল পরিষেবা, স্টার্ট-আপের মতো সোশ্যাল মিডিয়া৷ তাতে আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কমবে৷ তবে ইন্টারনেটকে কবজা করা নিয়ে ফেসবুককে ঘিরে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে বিতর্ক৷ শুরু হয়েছে অবাধ অন-লাইন অভিযানের পক্ষে এবং বিপক্ষে৷ ‘ফ্রি বেসিক' নামে অন-লাইন সার্ভিস সাধারণ মানুষ যোগাযোগ, স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, কর্ম সংস্থান ও কৃষি সংক্রান্ত খবরাকবর৷ এটা নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকবে নতুন বছরে৷
পররাষ্ট্রনীতি
রাশিয়াকে পাশে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমের ধণতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে ভারতের নৈকট্য তুলে ধরতে প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রয়াস নতুন বছরে এক ভিন্ন মাত্রা পেতে পারে৷ ইউরোপিয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ারও সম্ভাবনা৷ তবে ইইউ-ভারত অবাধ বাণিজ্য চুক্তির ভবিষ্যত এ বছরেও ঝুলে থাকবে৷ চীনের সঙ্গে স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে৷ ভারতের চিরাচরিত পাকিস্তান নীতিকে গ্রাহ্য না করে পারস্পরিক আস্থা বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী মোদী যেভাবে সরাসরি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দোড়গোড়ায় হাজির হলেন, আপাতদৃষ্টিতে তা নাটকীয় মনে হলেও এর রাজনৈতিক তাত্পর্য অনস্বীকার্য৷ এতে দু'দেশের বহুমাত্রিক সম্পর্কের জটিলতা কিছুটা হলেও শিথিল হতে পারে৷ সন্ত্রাস, কাশ্মীর ইস্যুর শক্ত জমিটা হয়ত কিছুটা নরম হয়েছে৷ তাই এই জানুয়রিতেই বৈঠকে বসতে চলেছেন দু'দেশের বিদেশ সচিব৷ মোদী-শরিফ মিলিত হতে পারেন এ মাসেই সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ফাঁকে৷ পশ্চিম এশিয়া নিয়ে মোদী সরকার আগ্রহী হতে দেখা যাবে৷ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রীদের আসন্ন দিল্লি সফর তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে৷ বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় ছেদ পডবে না৷ আফগানিস্তান ও নেপালের সঙ্গে সম্পর্কের একটা টানাপোড়েন চলছে৷ নেপালের সঙ্গে হয়ত সেটা মিটে যাবে৷ শ্রীলঙ্কা এবং আফগানিস্তানে ভারতের বৈষয়িক সাহায়্য অব্যাহত থাকবে৷
প্রতিরক্ষা
ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আগাগোড়া ঢেলে সাজাবার প্রক্রিয়া নতুন বছরে বিশেষ অগ্রাধিকার পাবে৷ যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং ইসরায়েল থেকে বড় রকম প্রতিরক্ষা সহযোগিতা পাওয়ার আশা করা যেতে পারে৷ আর সেটা হতে পারে মোদীর ‘মেক-ইন ইন্ডিয়া' কর্মসূচির অধীনে৷ প্রতিরক্ষা সমরাস্র সংগ্রহে রাশিয়ার স্থান বিঘ্নিত হবে না৷ নতুন বছরে দেশকে সার্বিক সাফল্যের মুখ দেখাতে না পারলে বিজেপিকে তার দাম চুকাতে হবে আগামী সাধারণ নির্বাচনে৷
বন্ধু, আপনি কি অনিল চট্টোপাধ্যায়ের এই বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত? জানান মন্তব্যের ঘরে৷