নথি ফাঁস: ‘কারণ ছাড়াই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে উইগুরদের'
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০তুরস্কের ইস্তানবুলের সুলতান মুরাত এলাকায় রয়েছে উইগুর মুসলিমদের একটি মসজিদ৷ মূলত একটি ভবনের বেসমেন্টে সেই মসজিদে চীন থেকে আসা উইগুর মুসলিমদের একটি দল সেখানে নামাজ আদায় করেন৷ চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং প্রদেশে হয়তো এই কাজকেই (ধর্মীয় আচার পালন) ভয়ঙ্কর কিছু ভাবা হয়৷ ২০১৬ সাল থেকে চীন সরকার এদের আটক করে ‘কারিগরি শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র' নামের কারাগার ও ক্যাম্পে রাখে৷
ইস্তানবুলের সেই মসজিদে আগতদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, এসব কারাগারে তাদের কার কার স্বজন আছেন? কিংবা নিখোঁজ আছেন? এদের সবাই হাত তোলেন৷ তারা তাদের স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মায়ের আইডি কার্ড, ছবি এসব দেখান৷
ছবি দেখিয়ে ডয়চে ভেলেকে একজন বলেন, ‘‘আমি জানি না আমার মেয়ে বেঁচে আছে কিনা৷''
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে মসজিদের ইমাম বলেন,‘‘চীন সরকার পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আমাদের সব লোকদের উচ্ছেদ করতে চায়৷ তারা উইগুরদের ও তাদের সংস্কৃতিকে হত্যা করতে চায়৷''
বিশ্বাস ও সংস্কৃতির কারণে যারা অন্তরীণ
জিনজিয়াং প্রদেশে প্রায় এক কোটি উইগুরের বাস৷ এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখ প্রদেশটির কারাগারগুলোতে নিখোঁজ অবস্থায় বন্দি আছেন বলে ধারণা করা হয়৷
জানা যায়, এসব কারাগার ও ক্যাম্পে অনেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দি আছেন৷ কেউ কেউ ফিরে আসেন ‘লেবার ক্যাম্পে'৷ যারা ঘরে ফেরেন, তাদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়৷
চীন কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব কারাগার হলো ‘কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র'৷ ‘চরমপন্থি' মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়তেই এগুলো তৈরি করা হয়েছে৷ বিনিময়ে তাদের ‘মূল্যবাণ কর্মদক্ষতার' প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে৷
সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বার্লিন সফর করেন৷ তখন তাঁকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন যে, বেশ কয়েকজন এনজিও কর্মী ও সাংবাদিককে জিংজিয়াং প্রদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷
‘‘তারা একটিও কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বা রি-এডুকেশন ক্যাম্প দেখেননি,'' বলেন ওয়াং৷ তিনি যোগ করেন, ‘‘জিংজিয়াংয়ে কোনো নির্যাতন চালানো হয় না৷''
কিন্তু সম্প্রতি ডয়চে ভেলে ও কয়েকটি জার্মান মিডিয়া হাউজের হাতে একটি নথি এসেছে৷ সেই নথির তথ্য চীনের সরকারি বক্তব্য সমর্থন করে না৷ সেখানে দেখা যায়, চীন উইগুরদের অন্তরীণ করে রেখেছে তাদের চরমপন্থি আচরণের জন্য নয়, বরং সাধারণ ধর্মীয় আচার ও সংস্কৃতি পালনের কারণে৷
ফাঁস হওয়া নথিটি ১৩৭ পৃষ্ঠার৷ সেখানে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে আটককৃত ৩১১ জন উইগুরের নাম ও আইডি নম্বর তালিকাভুক্ত করা আছে৷ শুধু তাই নয়, কারা এদের পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধব, তা-ও বিস্তারিত আছে সেখানে৷ মোট এক হাজার ৮শ' জন উইগুরের পুরো নাম ও আইডি এবং তাদের সামাজিক আচরণের তথ্য আছে সেখানে৷ সামাজিক আচরণ বলতে তারা বাসায় নামাজ বা কোরআন পড়েন কিনা - এসব৷ আরো কয়েকশ' নাম আছে, যাদের বিস্তারিত এখনো লিপিবদ্ধ করা হয়নি৷
লিপিবদ্ধ সবগুলো নাম ভারত ও তিব্বত সীমান্তবর্তী কারাকাক্স কাউন্টির৷ জিনজিয়াংয়ের তুলনায় লিপিবদ্ধ এলাকাটি খুব ছোট হলেও এটা স্পষ্ট যে চীন কর্তৃপক্ষ উইগুরদের সম্পর্কে ব্যাাপক তথ্য সংগ্রহ করেছে৷
নিরাপত্তা ক্যামেরায় তাদের চলাচলে প্রতিমুহূর্তে নজর রাখা হচ্ছে৷ স্মার্টফোন ‘ফেস রিকগনিশন' অ্যাপ ব্যবহার করতে বাধ্য করা হচ্ছে৷
এদের যেসব ‘অপরাধে' আটক করা হয়েছে, সেগুলো হলো, বৈধ সংখ্যার চেয়ে বেশি শিশু জন্ম দেয়া, পাসপোর্টের জন্য আবেদন করা, লম্বা দাঁড়ি রাখা ইত্যাদি৷ একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ছয় বছর আগে একটি ধর্মীয় ভিডিও ডাউনলোড করেছিলেন৷ সেজন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
নথিটিতে কোনো দাপ্তরিক সিল বা স্বাক্ষর নেই৷ কিন্তু ডয়চে ভেলে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে এবং এর ভাষা ও তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকরা বলেছেন, এটি যে চীন কর্তৃপক্ষের তৈরি করা তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ তালিকা থেকে কয়েকজনের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগও করেছে ডয়চে ভেলে৷
‘কোনো কারণ ছাড়াই গ্রেপ্তার'
নথি ফাঁসকারী ব্যক্তির নাম আবদুওয়েলি আয়ুপ৷ তিনি নরওয়েতে বসবাসরত একজন উইগুর অ্যাকাডেমিক৷ তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন৷ আয়ুপ জিনজিয়াংয়ে উইগুর ভাষা শিক্ষার স্কুল খুলতে চেয়েছিলেন৷ সেজন্য ১৫ মাস কারাবাস করতে হয় তাঁকে৷
দেশে নিজের পরিবার বিপদে পড়বে জেনেও আয়ুপ সামনে আসার সিদ্ধান্ত নেন৷ সম্প্রতি তাঁর স্ত্রীর পরিবারের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এমনকি ডিডাব্লিউকে সাক্ষাৎকার দেয়ার ঠিক আগে টেলিফোনে হুমকিও পান তিনি৷
‘‘আমি জানি, এটা বিপদজনক৷ কিন্তু কাউকে না কাউকে কথা বলতে হবে৷ বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে হবে কী হচ্ছে,'' বলেন তিনি৷
তালিকাটি হাতে পাবার পর স্তব্ধ হয়ে যান আয়ুপ৷ চীন কর্তৃপক্ষ যতই চরমপন্থার কথা বলুক, তাঁর মতে, ‘‘কোনো কারণ ছাড়াই লোকেদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে৷''
তালিকা থেকে আয়ুপ ২৯ জনের স্বজনকে খুঁজে বের করেন আয়ুপ৷ এদের প্রায় সবাই তুরস্কে থাকেন৷ এরা বছরের পর বছর জিনজিয়াংয়ে নিজেদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি৷ কারণ, বিদেশ থেকে যদি কোনো ফোনকল যায়, জিনজিয়াংয়ে থাকা তাদের স্বজনদের জেলে ঢোকানো হতে পারে, এই ভয়ে৷
‘‘আমি জানাই যে, তাদের আত্মীয়রা জেলে আছেন এবং তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন,'' বলেন আয়ুপ৷
‘আমার হৃদয় ভেঙে যায়'
আয়ুপ যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাদের একজন রোজিনিসা মেমেত তোহতি৷ তিনি একজন গৃহিনী ও তিন সন্তানের মা৷
তোহতি জানতে পারেন, তাঁর সবচেয়ে ছোট বোনটি আছেন তালিকায়৷ ‘‘বহুদিন আমি কিছু খেতে বা ঘুমোতে পারিনি৷ কখনো ভাবতে পারিনি আমার সবচেয়ে ছোট বোনটি জেলে যাবে৷''
তাঁর সবচেয়ে বড় বোন ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে ২০১৬ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ এই খবর আগেই জানতে পেরেছিলেন তোহতি৷
কিন্তু তিনি জানতেন না যে, তাঁর সর্বকনিষ্ঠ বোনটিও ২০১৮ সালের মার্চে আটক হন৷ তিনি বাকি আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন না৷ ভয় পেতেন, যদি তাদের কোনো ক্ষতি হয়৷
গ্রেপ্তার হওয়া বোন ও বোনের স্বামী একটি কেকের দোকান চালাতেন৷ তাই তোহতি কখনো ভাবেনইনি যে তারা গ্রেপ্তার হতে পারেন৷
‘‘আমি স্তব্ধ হয়ে যাই,'' খুব কষ্টে কান্না থামান তোহতি৷
জিনজিয়াংয়ে আইনগতভাবে গ্রামে লোকেরা তিনটি সন্তান ও শহরে দু'টি সন্তান নিতে পারেন৷ কিন্তু অনেক উইগুর তা মানেননি৷ তাঁরা ভেবেছিলেন যে, হয়তো জরিমানা করা হবে৷ কিন্তু তোহতির বোনকে বেশি সন্তান নেয়ার জন্য জেলে পাঠানো হয়৷ নথিতে তাঁর সম্পর্কে লেখা আছে যে, এখন তিনি (তোহতির বোন) ‘বিপদজনক নন' এবং তাই তাঁকে ‘কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র' থেকে ছেড়ে দেয়া হবে এবং ‘নজরদারিতে' রাখা হবে৷
তোহতি বলেন, দুই বছর আগে একজন কারাগার থেকে পালিয়ে তুরস্ক চলে আসেন৷ তাঁর কাছ থেকে কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তা শুনে পরিবারের সদস্যদের জন্য রীতিমতো ভয় পাচ্ছিলেন তিনি৷
‘‘তাঁরা যদি নিজেদের মধ্যে কথাও বলেন, তাহলেও নাকি মারা হয় এবং আলাদা কামরায় রাখা হয়,'' বলেন তোহতি৷
অন্য অনেকের মতো তোহতিও শুনেছেন যে, বন্দিদের অঙ্গ কেটে বিক্রি করা হয়৷
তোহতির ধারণা, তাঁর ভাগ্নে-ভাগ্নিদের উইগুর সন্তানদের জন্য তৈরি এতিমখানায় রাখা হয়েছে৷ সেখানে তাদের ভিন্ন মতাদর্শে দীক্ষা দেয়া হয়৷ তাদের উইগুর সংস্কৃতি ও পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা চালানো হয়৷
উইগুর জঙ্গিরা ‘শেষ দেখে ছাড়বেন'
চীনা কর্তৃপক্ষ সবসময়ই বলে আসছে যে, ক্যাম্পগুলো হলো উইগুর চরমপন্থার বিরুদ্ধে তাদের নেয়া ব্যবস্থা৷
২০০৯ সালে জিনজিয়াং প্রদেশের রাজধানী উরুমকিতে জাতিগত দাঙ্গায় ১৪০ জন নিহত এবং অসংখ্য আহত হয়৷ বিক্ষোভকারীরা চীনা অধিবাসীদের ওপর হামলা চালান এবং তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেন৷
২০১৪ সালে উরুমকির একটি মার্কেটে সন্ত্রাসী হামলায় ৩১ জন মারা যান৷ জবাবে চীন সরকার উইগুরদের ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে থাকে৷
চীনে উইগুর মুসলিমরা যুগ যুগ ধরে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার৷ এর কারণেই তাদের মধ্যে এই অসন্তোষ তৈরি হয়েছে৷
ইস্তাম্বুলে ডয়চে ভেলে একজনের সঙ্গে কথা বলেছে, যিনি সিরিয়ায় গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন৷
২০১৫ সালে তিনি আরো ৫০ থেকে ৬০ জন উইগুরের সঙ্গে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ)-এর সদস্যদের সঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন৷
যোদ্ধা হতে চাওয়া এই ব্যক্তি জানান, তিনি শিখেছেন কেমন করে কালাশনিকভ চালাতে হয় এবং কামান দাগাতে হয়৷
তিনি জানান, ছয় মাসের ঐ প্রশিক্ষণ নেবার মূল উদ্দেশ্য ছিল জিনজিয়াংয়ে ফিরে গিয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টের বিরুদ্ধে লড়াই করা৷ চীনের সামরিক ঘাঁটিগুলো এবং সরকারী চাকরি করা চাইনিজ হান গোষ্ঠীরাই এই দলটির মূল টার্গেট৷
ডয়চে ভেলেকে সেই উইগুর ব্যক্তি বলেন, ‘‘আমরা শেষ দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম৷''
তবে তিনি স্বীকার করেন যে, তুরস্ক ও ইউরোপে তাদের দলের অনেকে গ্রেপ্তার হওয়ায় পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে৷ তবে তিনি আবারো সংঘবদ্ধ হয়ে কাজে নেমে পড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন৷
যদিও ডয়চে ভেলে ঐ ব্যক্তির বক্তব্যের যথার্থতা নিশ্চিত করতে পারেনি, তবে এটা সত্য যে, উইগুরদের অনেকে এফএসএ-র সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন৷ এমনকি এই সম্প্রদায়ের কয়েকশ' জন ইসলামিক স্টেটে যোগদান করেছেন৷
গতবছর জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি গোপন প্রতিবেদন তৈরি করে, সেখানে বলা হয়েছিল যে, উইগুরদের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আফগানিস্তানের তালিবান ও আল-কায়েদার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে৷
তবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে চীন যেভাবে পুরো একটি জনগোষ্ঠীর ওপর তাদের নীতিগত অবস্থান নিয়েছে তা সমালোচিত হচ্ছে৷ তারা উইগুর ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে টার্গেট বানিয়েছে এবং জনগণকে কঠোর নজরদারিতে রেখেছে৷
তোহতির বোনের মতো অনেককে শুধু বেশি শিশু জন্ম দেয়ার ‘অপরাধে' যেমন কারাগারে পুরেছে, কেউ কেউ এমনকি আইনগত কোনো অপরাধ না করলেও তাকে জেলে নিচ্ছে৷
নাওমি কনরাড/জেডএ