নদীখাতে বাঁধ দিয়ে বালি চুরি বাংলাদেশ, আসামে
২০ ডিসেম্বর ২০২১উত্তরবঙ্গের নদী সঙ্কোশ। আলিপুরদুয়ার হয়ে যা আসামে গেছে। উত্তরবঙ্গের নদীগুলির মধ্যে সঙ্কোশ ও বালাসনের বালির মান সবচেয়ে ভলো। কিন্তু বালি মাফিয়ার অত্যাচারে সেই সঙ্কোশ নদীর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বালি মাফিয়াদের দাপটে মরে যেতে বসেছে সঙ্কোশ সহ উত্তরবঙ্গের একাধিক নদী।
আর এই বালি মাফিয়াদের সাহস ও তাণ্ডব এত বেশি যে, তারা সঙ্কোশে বেআইনি বাঁধ বানিয়ে নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়ে নির্বিচারে বালি তুলছিল। এই বালি, নদীর পাথর সব আসাম ও বাংলাদেশে পাচার হয়ে যায় বলে অভিযোগ। চ্যাংড়াবান্ধা দিয়ে তা বাংলাদেশে ঢোকে। আর আলিপুরদুয়ার থেকে তা চলে যায় আসামের দিকে। সম্প্রতি উত্তরবঙ্গ সংবাদ বলে স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে এই বাঁধ ও বালি পাচারের খবর প্রকাশিত হয়।
তারপর অভাবনীয় ঘটনা ঘটে। গত শুক্রবার ট্রাক, ট্র্যাক্টর নিয়ে কুমারগ্রামে ওই সাংবাদিক নৃসিংহপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনে অবরোধ গড়ে তোলা হয়। মাইক নিয়ে প্রচার চলে। দাবি করা হয়, সাংবাদিক মিথ্যা খবর লিখেছেন। এর ফলে তাদের রুটিরুজি বন্ধ হয়ে গেছে। উত্তরবঙ্গ সংবাদের রিপোর্ট বলছে, কুমারগ্রাম থানা থেকে নৃসিংহপ্রসাদের বাড়ি ঢিল ছোড়া দূরত্বে। তা সত্ত্বেও সাত ঘণ্টা ধরে অবরোধ চলে। আলিপুরদুয়ারের জেলাশাসকের হস্তক্ষেপে বিরোধ মেটে। বিডিও পুলিশ বাহিনী নিয়ে বাড়ি অবরোধমুক্ত করেন। আর খবর প্রকাশিত হওয়ার পর প্রশাসনের তরফে বেআইনি বাঁধ কেটে দেয়া হয়।
ছবিটা কী
উত্তরবঙ্গ সংবাদের কার্যনির্বাহী সম্পাদক রূপায়ণ ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''আমি তো লিখেছি যে, বালি তুলে উত্তরবঙ্গের অসংখ্য নদীকে মেরে ফেলা হচ্ছে। মহানন্দা, তিস্তা, তোর্ষা, বালাসন, জলঢাকা, সঙ্কোশ থেকে অবৈধভাবে বালি ও স্টোনচিপস তোলা হচ্ছে। দিনের পর দিন এই কাজ হচ্ছে।'' রূপায়ণ বলেছেন, ''বালি মাফিয়াদের দুঃসাহসের কথা ভাবুন। তারা কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে জলসংকটে ফেলেছে প্রচুর মানুষকে। সঙ্কোশের পাশে চা-বাগানের ভয়ংকর ক্ষতি হয়েছে। নদী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।''
শুধু উত্তরবঙ্গেই নয়, নয়, দক্ষিণবঙ্গেও একই সমস্যা আছে। প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''উত্তরবঙ্গ তো বটেই, দক্ষিণবঙ্গের নদী থেকেও নির্বিচারে বালি তোলা হচ্ছে। হইচই হলে তা সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে। তারপর আবার যে কে সেই।''
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তরবঙ্গের এক সাংবাদিক ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''চ্যাড়াবান্ধা দিয়ে বাংলাদেশে বালি, স্টোনচিপস, গরু পাচার হয়। সেখানে একবার গেলে দেখতে পাবেন, প্রায় সব বাড়িতে একটা করে ট্রাক ও গোয়াল আছে। দুটোই পাচারের কাজে ব্যবহৃত হয়।''
তার দাবি, ''সকালে গরু চলে আসে গোয়ালে। রাতে তা পাচার করা হয় সীমান্তের ওপারে। বালি, স্টোনচিপসও পাচার হয় অবাধে।''
অসমীয়া প্রতিদিন কাগজের দিল্লির ব্যুরো চিফ আশিস গুপ্ত একদিন আগেই গুয়াহাটি থেকে গাড়িতে কলকাতায় এসেছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''রাত হতেই দেখলাম, একটার পর একটা ট্রাক বালি নিয়ে আসামের দিকে যাচ্ছে। এই ছবি আগেও দেখেছি, এখনো দেখছি।''
এর ফল কী হতে পারে
যোজনা কমিশনের সাবেক উচচপদস্থ আমলা অমিতাভ রায় ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''এর ফলে পরিবেশগত বিপর্যয় হতে পারে। নদী গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। যেদিক থেকে সমানে বালি তোলা হচ্ছে, নদীর জল সেদিক দিয়ে বেশি করে বইবে। ফলে স্বাভাবিক খাত থেকে নদী সরে আসবে। এর ফলে প্রচুর মানুষ বিপন্ন হবেন।'' তার মতে, ''ভারতে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের নাম করে নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস করা হচ্ছে, গাছ কাটা হচ্ছে, নদী লুট হয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি ভয়ংকর।''
কেন বালি চুরি?
আশিস মনে করেন, ''রাজ্যে কর্মসংস্থান কমছে। বেকারদের সংখ্যা বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই ধরনের কাজ। মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা কর্তারা মাঝেমধ্যে বলেন, এসব বরদাস্ত করা হবে না। সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে। তারপর আবার শুরু হয়ে যায়। এর সঙ্গে পুলিশ ও প্রশাসনের যোগ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক।''
শুভাশিসও এর সঙ্গে একমত। তিনিও বলেছেন, ''বেকার ছেলেরা সধারণত এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।''
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা একটা বড় চক্র। যে চক্রের হাতে পড়ে নদী, জঙ্গল, জল, জানোয়ার সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।