‘নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে নির্ভরতা করতে প্রযুক্তি প্রয়োজন’
১৮ জুলাই ২০১৭ডয়চে ভেলে: টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কেন হয়েছিল?
সিদ্দিক জোবায়ের: ২০০৮ সালে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন নীতিমালায় ২০১৫ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ৫ শতাংশ এবং ২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়া আছে৷ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায়ও এ সম্পর্কে বলা আছে৷ আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে এই খাতে সরকারের পক্ষ থেকে কাজ করার জন্য এই কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে৷
বর্তমানে এই কর্তৃপক্ষ কী কী কাজ করছে?
এই কর্তৃপক্ষের দুটি টার্গেট৷ নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করা এবং জ্বালানি দক্ষতা বাড়ানো৷ ২০২০ সালের মধ্যে আমাদের ১০ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা তার পরিমাণ প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট৷ আমরা যদি দেখি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির যেসব প্রযুক্তি আমাদের কাছে আছে, তার মধ্যে সৌর বিদ্যুৎ আমাদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী৷ ২০১৮ সাল নাগাদ আমরা বায়ু সম্পদ মূল্যায়ণ প্রতিবেদন পাবো, তখন জানতে পারবো, এখান থেকে কত বিদ্যুৎ আসবে৷
এখন সৌর শক্তির উপরই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছি৷ মেগাওয়াট স্কেলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বড় প্রকল্প করার চেষ্টা করছি৷ ইতোমধ্যে ৩০২ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন চারটি বেসরকারি সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাথে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ‘পাওয়ার পারচেজ অ্যাগ্রিমেন্ট' স্বাক্ষরিত হয়েছে৷ আরো প্রায় ৫২৮ মেগাওয়াটের নয়টি প্রকল্পের জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চুক্তি স্বাক্ষর হবে৷
২০২০ সালের মধ্যে ১ হাজার মেগাওয়াট এখান থেকে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি৷ ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডিজেলচালিত সেচ পাম্পগুলোকে সৌর বিদ্যুৎ চালিত সেচপাম্পে রূপান্তরের কাজ করছি৷ আমাদের শ্যালোচালিত নৌকা চলে ডিজেলে৷ এগুলোকে সোলার দিয়ে স্থলাভিষিক্ত করতে চাই৷
নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে এখন কী পরিমাণ বিদ্যুৎ পাই?
এই মুহূর্তে আমরা ৪৪৪ মেগাওয়াটের মতো পাচ্ছি৷
২০২০ সালের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব?
আমরা খুবই আশাবাদী, যদিও এটা চ্যালেঞ্জিং হবে৷ আরেকটা খাত নিয়ে আমরা আশাবাদী, সেটা হচ্ছে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রুফটপ৷ এমনও রুফটপ আছে, যেখানে ৩-৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে৷ শিল্পগুলোও এতে আগ্রহ দেখাচ্ছে৷ আমরাও কাজ করছি৷
এর কারণ আমাদের ছোট্ট দেশ৷ এখানে সোলারের জন্য জমি পাওয়া খুবই চ্যালেঞ্জিং৷ তাই এটাকে ব্যবহার করতে পারলে আমাদের হিসাব অনুসারে প্রায় সাড়ে চারশ' মেগাওয়াট রুফটপ থেকে আনতে পারি৷
অনেকে মনে করেন, নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে খরচ বেশি পড়ে৷ তাই এটা বাংলাদেশের জন্য উপযোগী না৷ আপনারা কী মনে করেন?
আমার মনে হয়, এটা আজ থেকে ৩ বছর আগে পুরোপুরি সত্য ছিল৷ ২০১৭ সালের দ্বিতীয়ার্ধে এসে এটা মোটেই সত্য না৷ শিল্পে বর্তমানে বিদ্যুতের যে ট্যারিফ আছে, আমাদের ধারণা এটা এখানে থাকবে না৷ ভ্যাটসহ তাদের বর্তমানে পার কিলোওয়াট আওয়ার ৯ টাকার মতো পড়ে৷ এটা আরও বাড়বে৷ আমাদের গ্যাস কম৷ তাই এলএনজি আমদানি করতে হবে৷ তখন আমার ধারণা আরও কিছুটা বৃদ্ধি পাবে৷ না বাড়লেও সোলার রুফটপ ভালো বিকল্প৷ আমরা সমীক্ষা করেছি, সোলার কোনোভাবেই ৯ টাকার বেশি হবে না৷ অনগ্রিড এরিয়া হওয়ায় এখানে আমরা ব্যাটারির চিন্তা করছি না৷ তবে অফগ্রিড এরিয়ায় আবার খরচটা একটু বেশি হবে৷
বাংলাদেশে সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রই দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে যায়...
আমাদের এই প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা একটু কম৷ কারণ, আমাদের এই প্রকল্পগুলো মূলত বাস্তবায়িত হবে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে৷ আমরা যদি একটা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে পারি, তাহলে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা সময় বেশি নেয় না৷
আমরাও অনেক সময় নিয়েছি৷ ২০০৮ সালে আমাদের নীতিমালা হয়েছে৷ ২০০৯ সাল থেকে ধরলেও ২০১৭ পর্যন্ত আট বছর সময় নিয়ে ফেলেছি৷ আমরা মনে করি, যথেষ্ট সময় নিয়েছি৷
অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যে ধরণের তথ্য-উপাত্ত, কারিগরি জ্ঞান সেগুলো দেশে এরই মধ্যে হয়ে গেছে৷ তাই ২০২০ সাল পর্যন্ত মন্থর গতি আর থাকবে না৷ আমরা যখন ২০০৩ সালে সোলার হোম সিস্টেম চালু করি, তখন থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে আমাদের প্রতি মাসে যে পরিমাণ সিস্টেম বিক্রি হতো, ২০০৯-২০১৫ সালে প্রতিদিনে সে পরিমাণ সিস্টেম বিক্রি হয়েছে৷ সোলার ইরিগেশনেও একই অবস্থা৷ ২০১১ সাল থেকে এখানে কাজ শুরু করি৷ ২০১৬ পর্যন্ত বসাতে পেরেছি মাত্র ৫০টা ইরিগেশন সিস্টেম৷ এরপর এ পর্যন্ত ৬০০টা বসে গেছে৷
এটা নতুন প্রযুক্তি, তাই শুরুর দিকে আমাদের কারিগরি জ্ঞানের অভাব ছিল৷ এখানে বিনিয়োগ করবে কিনা, তা নিয়ে আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দ্বিধা ছিল৷ আমরা আশা করি, ২ হাজার মেগাওয়াটের লক্ষ্য অতিক্রমও করে যেতে পারি৷
ডেনমার্কের অর্থায়নে কক্সবাজারে ৬০ মেগাওয়াটের একটা বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ার কথা শুনেছি, যেটি ২০১৭ সালে উৎপাদনে যাওয়ার কথা৷ সেটার কী অবস্থা?
এটা ডেনমার্কের অর্থায়নে না৷ মার্কিন অর্থায়ন এবং ডেনমার্কের প্রযুক্তিতে হওয়ার কথা৷
বায়ু বিদ্যুতে আমরা (সংস্থার পক্ষ থেকে) এখন কাজ করছি না৷ এটা আমরা করবো ২০১৮ সালে গিয়ে৷ সেই প্রকল্প ছিল একটা আনসলিসিটেড অফার যে, তারা ওখানে সমীক্ষা করে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে৷ ওই প্রকল্পের কিছু সমস্যা ছিল, একটা হচ্ছে, সেখানে কোনো ‘উইন্ড রিসোর্স অ্যাসেসমেন্ট' করা নাই৷ এটা করা না থাকলে ওখানে বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প করা যাবে কিনা, কারিগরিভাবে সেটা জানার উপায় নাই৷ আর সেটা না থাকলে কেউ সেখানে অর্থায়নও করবে না৷ গত বছর তারা এই সমীক্ষা করা শুরু করেছে৷ সেপ্টেম্বরে হয়ত রিপোর্ট দিতে পারবে৷ তারপর বলা যাবে কখন এটা করা সম্ভব হবে৷
২০১৭ সালে হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই৷ আমরা শ্রেডা থেকে এখন বায়ুভিত্তিক কোনো প্রকল্প করার পক্ষে না৷ ফেনীর মুহুরীতে একটি প্রকল্পে আমরা সহায়তা দিচ্ছি, কারণ, যারা করছে, তারা এরই মধ্যে আড়াই বছরের ডাটা সংগ্রহ করেছে৷ এটা (চালু করা সম্ভব) হবে৷
নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত বাংলাদেশের জ্বালানির প্রধান উৎস হতে কতদিন সময় লাগবে বা এ বিষয়ে আপনাদের কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
নিকট ভবিষ্যতে এটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখি না৷ তবে আপনি বলবেন, আমি কি আশাবাদী না? আমি বলবো, আমি আশাবাদী৷ তবে এর জন্য টেকনোলজিক্যাল ‘ব্রেক থ্রু' লাগবে৷ নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রযুক্তির বিষয়ে বিশ্বজুড়েই অনেক গবেষণা হচ্ছে৷ বাংলাদেশের জন্য সোলারই সবচেয়ে উপযোগী৷ কিন্তু এখানে এক মেগাওয়াটের জন্য ৪ একর জায়গার প্রয়োজন হয়৷ বাংলাদেশ ছোট ভূখণ্ডের দেশ৷ সব জায়গায় আমাদের জনবসতি আছে৷ প্রতি একর জায়গাই চাষের আওতায়৷ সেখানে আমাদেরকে ফসল ফলাতে হয়৷ আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে সেক্রিফাইস করে এটা করতে পারবো না৷
বর্তমানে সোলার প্যানেলের ‘জ্বালানি দক্ষতা' ১৬-১৭ শতাংশ৷ কেউ বলে ২১-২২ শতাংশ৷ এটা যদি বেড়ে হাফ একরে এক মেগাওয়াট হয়, তাহলে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ মূল বিদ্যুৎ হয়ে যেতে পারে৷
উন্নত অর্থনীতির দেশের জন্য এটা খুব সহজ৷ কারণ, তাদের অর্থনীতি এরই মধ্যে উন্নত হয়ে গেছে৷ তাদের প্রবৃদ্ধি অনেক কম৷ কিন্তু আমাদের প্রবৃদ্ধি অনেক৷ এই অবস্থায় আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা দিনদিন প্রচুর বৃদ্ধি পাচ্ছে৷
বিপুল পরিমাণ জ্বালানি চাহিদা বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে শতভাগে যাওয়া নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব হবে না৷ সুদূর ভবিষ্যতে এটা সম্ভব হবে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷