‘নব্য নাৎসি সন্ত্রাস মূলেই বিনাশ করতে হবে'
১৬ নভেম্বর ২০১১অকাট্য প্রমাণ না পাওয়া গেলেও এখনো পর্যন্ত যেটুকু জানা গেছে, তা শুনলে শিউরে উঠতে হয়৷ জার্মানির পূর্বাঞ্চলে সুইকাউ শহরে এক উগ্র দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী সম্ভবত প্রায় ১২ বছর ধরে বিনা বাধায় একের পর এক অপরাধ করে গেছে৷ তারা ১০ জনকে হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই অভিবাসী৷ প্রায় ডজন খানেক ব্যাংক ডাকাতির জন্যও তারা দায়ী৷ আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন এই সব হিংসাত্মক ঘটনার পেছনে আসলে যে উগ্র দক্ষিণপন্থী ঘৃণার আদর্শ কাজ করছিলো, তা কারো চোখে পড়ে নি৷
ব্যর্থতার কারণ সন্ধান
জার্মানির মতো দেশে এমন গাফিলতি কীভাবে ঘটতে পারলো? এখানে পুলিশ ও অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা অত্যন্ত সক্রিয়৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, এই সব ঘটনার পেছনে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের হাত থাকতে পারে এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় নি৷ কর্তৃপক্ষ কি ইসলামপন্থী উগ্রবাদীদের নিয়েই এত ব্যস্ত রয়েছে, যে অন্য কিছু তাদের চোখেই পড়ে না? নাকি উগ্র দক্ষিণপন্থী ভাবধারা সমাজে তেমন আপত্তিকর বলে মনে হয় না বলে এমন উদাসীনতা দেখা গেল? অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার অনেক কর্মী ছদ্মবেশে এই সব গোপন বা নিষিদ্ধ সংগঠনের মধ্যে সক্রিয়, একথা সবাই জানে৷ তারা কি ঠিকমতো তথ্য সরবরাহ করে নি বা করতে চায় নি?
এই সব প্রশ্নের জবাব খুঁজে বার করতে হবে৷ কোনো রাখঢাক না করে, দ্রুত সমগ্র চিত্র সম্পর্কে জানতে হবে৷ জার্মান সরকার এমনই অঙ্গীকার করেছেন৷ ভালো কথা৷ কিন্তু শুধু রাজনৈতিক স্তরে এই রহস্য উন্মোচন করলে চলবে না৷ বৃহত্তর সমাজেও ধারাবাহিক হিংসার এই সব ঘটনা নিয়ে বিতর্কের প্রয়োজন রয়েছে৷ কারণ জার্মানি আজ অভিবাসীদেরও দেশ৷ এতকাল ধরে অজ পাড়াগাঁয়ে, পাড়ার আড্ডায়, শুঁড়ীখানায় টেবিলে মানুষের ভয়কে উসকে দিয়ে উগ্র দক্ষিণপন্থার বীজ ছড়ানো হয়েছে৷ আজকের জার্মানিতে এমন অন্ধ আদর্শ ও তার ভিত্তিতে হিংসার কোনো স্থান নেই৷
সমাজে উগ্র দক্ষিণপন্থী ভাবধারার গ্রহণযোগ্যতা
প্রায় দুই দশক আগে নব্য নাৎসিরা ম্যোলন শহরে দুই তুর্কি পরিবারের বাড়ির মধ্যে মলোটভ ককটেল ছুঁড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ গোটা দেশ ও বিদেশেও এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল৷ কিন্তু এখন যে সিরিজ হামলার কথা জানা গেল, তাতে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে বর্ণবাদের ধারণা সমাজে আজও গ্রহণযোগ্য৷ বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলের কিছু এলাকায় নব্য নাৎসিরা দিব্যি কোনো একটি গ্রামকে ‘মুক্ত এলাকা' বা ‘জাতীয় এলাকা' ঘোষণা করে থাকে৷ সেখানে তারা বুক ফুলিয়ে নাৎসি আমলের গান গায়৷ সেখানে কেউ ভিন্ন মত পোষণ করলে চোখ রাঙানির ভয় আছে, সে তারা বিদেশি হোক বা বামপন্থীই হোক৷ বলা হয়, ‘এরা তো হাতে গোনা সামান্য কয়েক জন'৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যারা সেই ভাবধারা কার্যকর করতে হিংসার পথে যেতে প্রস্তুত, তাদের সংখ্যা তো কম নয়! তাদের অভিসন্ধির কথা জেনেও মুখ বন্ধ রাখা বা একেবারে নীরব থাকার মানুষও তো কম নয়! সেখানেই আসল বিপদ৷ উগ্র দক্ষিণপন্থা সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমেই এই আদর্শের মোকাবিলা করা সম্ভব৷
আধুনিক জার্মানিতে উগ্র দক্ষিণপন্থী ভাবধারা অচল
বহু দশক ধরে জার্মানিতে অভিবাসীরা আসছেন৷ তা সত্ত্বেও এদেশে বিচ্ছিন্ন ও সমান্তরাল চিন্তা-ভাবনার কাঠামো চলে আসছে৷ তারা আমাদের মৌলিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পরোয়া করে না৷ ‘বিদেশি বা ‘বাইরের লোক'ই সব সমস্যার মূলে – তাকেই লক্ষ্য করে অন্ধ বিশ্বাস উসকে দেওয়া হয়৷ বেকারত্ব বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশার কারণে অনেকে সমাজে নিজেদের হেরে যাওয়া শ্রেণী হিসেবে গণ্য করে৷ তাদের অনেকের মনে এমন বিকৃত ভাবনা বাসা বাঁধে৷ মধ্যযুগেও ঠিক এমনটাই দেখা যেত – যাবতীয় উদ্যোগ সত্ত্বেও আজও তা পুরোপুরি লোপ পায় নি৷ সুইকাউ শহরে গোপন নব্য নাৎসি সংগঠনের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছিল কি না, তদন্তের মাধ্যমে তা জানা যাবে – এমনটাই আশা করা যায়৷
কিন্তু এমন অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই৷ গোটা ইউরোপের গড় অনুপাতের তুলনায় জার্মান সমাজে বিদেশিদের সংখ্যা সামান্য বেশি, প্রায় ১০ শতাংশের মতো৷ কিন্তু শুধু এই ৭০ লক্ষ বিদেশি নয়, আমাদের সংবিধান ও শুভবুদ্ধির স্বার্থেই আমাদের নব্য নাৎসি সন্ত্রাস মূলেই বিনাশ করতে হবে৷ এটা না করতে পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার৷ অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা ও সমাজের বাঁধনও নষ্ট হয়ে যেতে পারে৷
প্রতিবেদন: উটে শেফার /সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক