নারী মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের ‘মা’
২৫ মার্চ ২০১৮অনেক রক্ত, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা৷ বাংলার চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে লাখ লাখ ছাত্র-যুবা, কৃষক-শ্রমিক, মুটে-মজুর যেমন বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন, তেমনি বাংলার অসংখ্য নারীও প্রাণ দিয়েছেন, হয়েছেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আর তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার৷ পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের বর্বরতার শিকার ওই নারীদের এতদিন শুধু ‘বীরাঙ্গনা’ বলেই সম্মান জানানো হতো৷ তবে স্বাধীনতার চার দশক পরেও সমাজে তাঁর ছিলেন যেন অবাঞ্চিত৷ লাঞ্চনা, ধিক্কার ও তিরস্কার ছিল তাঁদের অনেকের নিত্যসঙ্গী৷
তবে ২০১৫ সালে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার৷ সেই সুবাদে সিরাজগঞ্জের বীরাঙ্গনাদের মুখেও ফুটেছে গর্বের হাসি৷
তবে তাঁদের এ প্রাপ্তির নেপথ্যে যিনি, এতকাল সাহস ও প্রেরণা হয়ে যিনি তাঁদরে পাশে ছিলেন, দীর্ঘ পথ যিনি অগ্রসৈনিক হিসেবে নের্তৃত্ব দিয়েছেন, তিনি হলেন নারী নেত্রী সাফিনা লোহানী৷ সিরাজগঞ্জের সুপরিচিত প্রগতিশীল পরিবার লোহানী পরিবারে তাঁর জন্ম৷ বাবা শওকত লোহানী আর চাচা বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক কামাল লোহানী৷ আরেক চাচা প্রয়াত ফতেহ লোহানী ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র অভিনেতা, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, অনুবাদক, লেখক, সাংবাদিক ও উপস্থাপক৷
‘মায়ের জন্যই আজ বাঁচতে পারছি, স্বীকৃতি পেয়েছি’
সাফিনা লোহানীর পুরো জীবনটাই ব্যয় করেছেন স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে৷ দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ধরে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তিনি এসব নারীকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন৷ তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছেন৷ তাঁর আন্দোলন ও প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতেই স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পান সিরাজগঞ্জের এসব বীরমাতারা৷
শনিবার (২৪ মার্চ) সিরাজগঞ্জের স্বীকৃতি পাওয়া বেশ ক’জন নারী মুক্তিযোদ্ধা সাথে কথা হলো৷ তাঁরা বললেন, ‘‘স্বাধীনতার পর কেউ যখন আমাদের আশ্রয় দেয়নি, তখনই বঙ্গবন্ধু আমাদের মেয়ে ডেকে বাবার নামের জায়গায় তাঁর নাম লিখতে বলেছিলেন৷ আর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মায়ের মমতা দিয়ে বুকে জড়িয়ে নেন সাফিনা লোহানী৷ তাঁর কারণে সমাজে আমরা মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারছি৷ শেষ বয়সে এসে আমরা সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছি৷’’
নারী মুক্তিযোদ্ধা রাহেলা বেগম, হাজেরা বেগম, কমলা বানু, হামিদা বেগম জানান, স্বাধীনতার পর সমাজে কোথাও তাঁদের ঠাঁই হয়নি৷ স্বামী কিংবা বাবা-মা কেউ তাঁদের ঘরে তুলে নেয়নি৷ সে অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের বীরাঙ্গনা নারী পুনর্বাবাসন কেন্দ্রে আশ্রয় দিয়েছিলেন৷ কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সেই আশ্রয়টুকুও কেড়ে নেয়া হয়৷ আবারও সমাজচ্যুত হয়ে তাঁরা দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন৷ অন্যের বাড়ি কাজ করে খাবেন, তা-ও সম্ভব হয়নি, কেউ কাজও দিতে চায়নি তখন৷ নিজ এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন দূরে৷ ঠাঁই নিয়েছিলেন রেললাইন কিংবা ওয়াপদা বাঁধের পাশের সরকারী জায়গায়৷ ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরে থেকেছেন অনেক দিন৷ খুব কষ্টে কাটছিল দিন৷
কয়েক বছর পর হঠাৎ করেই সাফিনা লোহানী খুঁজে বের করেন তাঁদের৷ মুক্তিযোদ্ধা রাহেলা বলছিলেন, ‘‘তাঁর চেষ্টায় আবার আমরা একত্রিত হই৷ তিনি মায়ের স্নেহ দিয়ে আমাদের বুকে তুলে নেন৷ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন৷ তাঁর অফিসটাই ছিল আমাদের জন্য৷ অভাব দূর করতে বিভিন্নভাবে টাকা সংগ্রহ করে আমাদের মধ্যে বিতরণ করেছেন তিনি৷’’
সিরাজগঞ্জ শহরের সয়াধানগড়া মহল্লার নারী মুক্তিযোদ্ধা মাহেলা বেগম বলেন, ‘‘আজ আমরা সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছি আমাদের মায়ের (সাফিনা লোহানী) কারণেই৷ এই স্বীকৃতির জন্য তিনি অনেক কষ্ট করেছেন৷ আমরা এখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পাচ্ছি৷ সমাজে কেউ আমাদের ঘৃণা করে না৷ আত্মীয়-স্বজনসহ এলাকার মানুষ আমাদের সম্মান দেয়৷’’
নারী নেত্রী সাফিনা লোহানী এখন অসুস্থ৷ পক্ষাঘাতগ্রস্থ হওয়ায় সিরাজগঞ্জ শহরের এস এস রোডস্থ নিজ বাড়িতেই থাকছেন৷ বাইরে বের হতে পারেন না৷ মুখের কথাগুলোও অস্পষ্ট হয়ে গেছে৷ অনেক অনেক কিছুই মনে রাখতে পারেন না৷ অতি কষ্টে স্মৃতি হাতড়িয়ে তবু কিছু কথা বললেন তিনি৷
বীরাঙ্গনাদের জন্য সাফিনা লোহানীর সংগ্রাম
‘‘১৯৭২ সালে সিরাজগঞ্জে বীরাঙ্গনা নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ শহরের বিএ কলেজ মাঠে প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করি আমি৷ ওই সময় লাঞ্চিত এসব নারীকে সামাজিকভাবে নানা গঞ্জনার শিকার হতে হয়েছে৷ জেলায় অসংখ্য বীরাঙ্গনা থাকলেও, তাঁদের মধ্যে ৩৬ জন বীরাঙ্গনা আশ্রয় নেন এ পুনর্বাসন কেন্দ্রে৷ যাঁদের পরিবার বিষয়টি মেনে নিয়েছে তাঁরা আশ্রয়কেন্দ্রে আসেননি৷ ৭৫-এর ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমানের সামরিক আদেশে এ কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়া হয়৷ তখন আশ্রয় নেয়া অসহায় বীরাঙ্গনা নারীরা নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন৷’’
‘‘১৯৭৮ সালে আমার প্রতিষ্ঠা করা সিরাজগঞ্জ উত্তরণ মহিলা সংস্থার মাধ্যমে ওইসকল বীরাঙ্গনাকে খুঁজে বের করি৷ তাঁরা খুবই অভাব-অনটনের মধ্যে ছিলেন৷ নিজ পরিবার, সমাজ, এমনকি প্রতিবেশীদের কাছেও তাঁরা আশ্রয় পাননি৷ তাঁদের না ছিল থাকার জায়গা, না ছিল খাবার ব্যবস্থা৷’’
‘‘খুঁজে খুঁজে ৩৬ জনের মধ্যে ২১ জন বীরাঙ্গনার সন্ধান পাই৷ আমি তাঁদের ঐক্যবদ্ধ করি৷ বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থার কাছে তাঁদের কষ্টের জীবনের কথা তুলে ধরে আর্থিক সাহায্য নিয়ে ২১ বীরাঙ্গনার মধ্যে বিতরণের পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন ত্রাণ সহায়তা পাওয়ারও চেষ্টা করি৷’’
‘‘আমি তাঁদের বোঝাই, সমাজে আপনাদের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে৷ স্বাধীনতার জন্য আপনাদের সবকিছু হারাতে হয়েছে৷ এটা কোনো লজ্জার বিষয় নয়, এটা গর্বের বিষয়৷ সরকারি স্বীকৃতির জন্য আপনাদের আন্দোলন করতে হবে৷’’
‘‘নানা অত্যাচারে জর্জরিত ভীত-সন্ত্রস্ত এই নারীরা আমার কথায় প্রথমে সাড়া দেয়নি৷ তাঁরা ভয় পায়৷ তবুও আমি হাল না ছেড়ে তাঁদের কাছে কাছে থাকি৷ বুঝিয়ে বুঝিয়ে তাঁদের মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করি৷ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁদের কথা বলি৷ এদের নিয়েও যাই অনেক অনুষ্ঠানে৷’’
‘‘বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে দীর্ঘদিন বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ অনেক বছর সব কার্যক্রম খুব গোপনেই পরিচালনা করতে হয়েছে৷ তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে এ কার্যক্রম ভিন্নমাত্রা পায়৷ ওই সময়েই এক পর্যায়ে নাট্য ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর উপস্থাপনায় চ্যানেল আই-এর একটি অনুষ্ঠানে ৮ বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়৷ আর সেই থেকে দেশবাসীর নজরে আসে সিরাজগঞ্জের নির্যাতিত বীরাঙ্গনা নারীদের অসহায় জীবনযাপনের বিষয়টি৷’’
‘‘এরপরও অনেক প্রতিকুলতা এসেছে৷ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে আবারও মুখ থুবড়ে পরে আমাদের কার্যক্রম৷ তবে বিভিন্ন মিডিয়া ফলোআপ সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে এ আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখে৷’’
অবশেষে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন বীরাঙ্গনারা
বীরাঙ্গনাদের সমন্বিত তালিকা প্রস্তুত করে গেজেট আকারে প্রকাশ এবং তাঁদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির নির্দেশনা চেয়ে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে সিরাজগঞ্জ শহরের সালেহা ইসহাক সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী সংগঠনের সভাপতি মিতালী হোসেন ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন৷ এ বছরের অক্টোবর মাসে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) বীরাঙ্গনাদের নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷
স্বীকৃতি পেয়েছেন যাঁরা
কয়েক দফায় স্বীকৃত পাওয়া নারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন: আয়মনা, আছিয়া বেগম, মৃত সূর্য্য বেগম, কমলা বেওয়া, জয়গন নেছা, সুরাইয়া খাতুন, মাহেলা বেগম, হামিদা বেওয়া, মোছাম্মত হাসনা বেগম, মৃত রাজুবালা দে, রমিছা বেওয়া, ছামেনা খাতুন, শামছুন্নাহার, আছিয়া বেগম, মৃত জোসনা ভানু, আয়েশা বেগম, করিমন খাতুন, নুরজাহান বেগম, হাজেরা খাতুন, রাহেলা খাতুন ও ভানু খাতুন৷
এটিএন বাংলা ও এটিএন নিউজের সাংবাদিক ফেরদৌস হাসান সিরাজগঞ্জের বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রাপ্তির জন্য মূল কৃতিত্বটা সাফিনা লোহানীকেই দিলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা সাফিনা লোহানীকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি৷ তিনি বীরাঙ্গনা নারীদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে নিরলস শ্রম দিয়েছেন৷ সাংবাদিকদেরও উদ্বুদ্ধ করেছেন৷’’
মুক্তিযোদ্ধা ডা. গাজী জহুরুল ইসলাম রাজা বলেন, ‘‘নারী নেত্রী সাফিনা লোহানী শুধু সিরাজগঞ্জ নয়, সারাদেশেরই বীরাঙ্গনাদের জাগিয়ে তুলেছেন৷ তিনিই প্রথম এসব নির্যাতিত নারীর বিষয়ে আন্দোলন শুরু করেন৷ পর্যায়ক্রমে সারাদেশেই ওই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে৷’’
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার গাজী সোহরাব আলী সরকারেরও একই কথা৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে মুক্তিযোদ্ধাদের মতো এই সকল নারীদেরও অবদান রয়েছে৷ তবুও এতদিন বাংলার সমাজ ব্যবস্থা তাঁদের লাঞ্চনাই দিয়েছে৷ সাফিনা লোহানীর দীর্ঘ শ্রম আজ স্বার্থক হয়েছে৷ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বীরাঙ্গনাদের মর্যাদা দিয়েছেন৷ আশা করা যায়, এখন একজন মুক্তিযোদ্ধার মতোই ভাতাসহ সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করবেন এসব নারীরা৷’’