নারীকে পরিবারই যখন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়
৩১ জুলাই ২০২০দুটি ঘটনা৷ একটি মুর্শিদাবাদের৷ মেয়ের করোনার লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে হাসপাতালে পাঠাচ্ছেন না বাবা-মা৷ কারণ, লোক জানাজানি হয়ে গেলে পরে মেয়ের বিয়ে দেওয়া সমস্যা হবে৷ আরো ভয়ঙ্কর খবর হুগলি জেলার৷ বাড়ির বধূটি করোনা আক্রান্ত৷ কিন্তু তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে না, কারণ, তিনি চলে গেলে বাড়ির রান্না কে করবে? একই সঙ্গে অশিক্ষা, কুসংস্কার এবং স্বার্থপরতা ও অমানবিকতার এই দুই নজির আরো একবার সমাজের দৈন্যদশা নজরের সামনে তুলে ধরল৷ কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তাঁকে বাড়ি-ছাড়া, পাড়া-ছাড়া করা, তিনি রোগ সারিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে এলেও তাঁকে সামাজিকভাবে বয়কট করার অসংখ্য ঘটনার পাশাপাশি এই দুটি ঘটনা আবার প্রমাণ করল, করোনার থেকেও কত নির্মম রোগ এই সমাজের গভীরে পৌঁছে গেছে৷
‘‘এগুলো শুনে যে খুব আশ্চর্য হই, বা আকাশ থেকে পড়ি- এমন নয়৷’’ বললেন বাংলা থিয়েটার এবং সিনেমা, সিরিয়ালের জনপ্রিয় অভিনেত্রী রায়তী ভট্টাচার্য, যিনি একজন ডাক্তারও বটে৷ রায়তীর বক্তব্য, ‘‘আমরা যে সমাজে আছি, মুখে যতই বলি না কেন নারী স্বাধীনতা, ইকোয়ালিটি, উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট, ভেতরে ভেতরে ব্যাপারগুলো এখনো কিন্তু এরকমই থেকে গেছে৷ এখনো মেয়েদের গায়ের রং কালো হলে বিয়ের সমস্যা হয়৷ এবং বউ মানে সে বাড়ির কাজ করবে, সে বাড়ির কাজের লোক ধরে নিয়েই বিয়েটা দেওয়া হয়৷ গ্রামের ভেতরের দিকে আমি জানি অবস্থাটা৷ মানে, মেয়ে চাকরি-করা না হলেই ভাল, যাতে অন্তত সংসারের কাজগুলো সে করতে পারবে৷ এরকম একটা মানসিক জায়গায় মানুষ আছে৷ সেখানে দাঁড়িয়ে, বউয়ের করোনা হয়েছে, (কিন্তু) রান্না করতে পারবে না বলে তাকে হাসপাতালে দেবে না, বা মেয়ের করোনা হয়েছে জানাজানি হলে বিয়ে হবে না, এ ধরনের মানসিকতা খুব অবাক করা কিছু না৷’’
রায়তী বলছেন, এমন ঘটনা শহরের থেকে গ্রামাঞ্চলে বেশি, যেহেতু শহরেবিষয়টা নিয়ে সামাজিক স্তরে, বা সোশাল মিডিয়ায় আলোচনা করা যায়, কিন্তু গ্রামে ওই সংস্কারের পক্ষেই জনমত প্রবল৷ সাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু মনে করছেন, পিছিয়ে থাকায় শহর–গ্রামে বিশেষ ফারাক নেই৷ তিনিও অবশ্য ঠিক রায়তীর মতোই বললেন, যে এই ঘটনাগুলো শুনে তাঁর যে খুব অবাক লাগে, তা নয়৷ বরং এটা এমন একটা পশ্চাদমুখী মানসিকতা, যেটা শহর, গ্রাম, মফস্বল, সর্বত্র আছে৷ সঙ্গীতা বললেন, ‘‘আমি যে এই মানুষগুলোকে দোষী, বা একেবারে পাপী-তাপী ভাবতে পারি, তাও না৷ এটা আসলে পুরো সোসাইটিরই একটা প্রতিফলন...সোশাল মিডিয়ার কারণে এক বিরাট সংখ্যক মানুষকে আমরা জানতে পারি, যাঁদের মুখের ভাষণটা একরকম, কিন্তু মনের গভীরে কতগুলো সমস্যা, কতগুলো দিক এত ‘ডিপ রুটেড', যে আমি খুব একটা অবাক হই না৷’’
কথার সূত্রে করোনা লক ডাউনের সময় ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স', অর্থাৎ, গার্হস্থ্য নিগ্রহ বেড়ে ওঠার প্রসঙ্গও উঠল, যেখানে সেই মেয়েরাই আক্রান্ত৷ এক্ষেত্রেও সঙ্গীতার বক্তব্য, এটা হঠাৎ জেগে ওঠা কোনও প্রবণতা নয়৷ সবসময়ই সমাজে এটা ছিল৷ পরিচিত এক মহিলার দুরবস্থার কথা জানালেন সাহিত্যিক, যাঁর স্বামী লক ডাউনের সময় স্ত্রীকে দুবেলা ভরপেট খেতে দেয়নি স্রেফ এই আতঙ্ক থেকে যে তার চাকরি থাকবে না, সঞ্চয়ে টান পড়বে! কাজেই নানা চেহারায় ধরা পড়ছে সমাজের হীন মানসিকতা, এই লক ডাউনের সময়ে৷ মুর্শিদাবাদের ঘটনাটির প্রসঙ্গে সঙ্গীতা জানালেন আরও একটি ঘটনার কথা, যেখানে মেয়েটির অ্যাপেনডিক্স অপারেশনের কথা বাড়ির লোক চেপে গেছে, কারণ শরীরে কাটাছেঁড়ার দাগ থাকলে বিয়ে হবে না৷ ‘‘কী হলে মেয়েদের বিয়ে হবে না— এই লিস্টের কোনো শেষ নেই!’’ বলছেন সঙ্গীতা৷ তাঁর কথায়, ‘‘এই যে ভয়ঙ্কর একটা মাইন্ডসেট, এত গভীরভাবে রুটেড, এটাকে সারাক্ষণ শেমিং, সারাক্ষণ কথা বলা এবং প্রচণ্ডরকম শেম করা ছাড়া এটা (যাবে না)৷ মুশকিল হচ্ছে, আমরা একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে বসে কথা বলছি৷ সত্যি সত্যিই যাদের এটাকে ওভারকাম করা দরকার, আমরা কি তাদের কাছে পৌঁছতে পারছি? আমার খুব সংশয় হয়৷ তার কারণ এডুকেশন তো কোনওভাবে (সমস্যাগুলো) হাইলাইট করে না! যে পরিমাণ নারী নিগ্রহ, যে পরিমাণ নারী শোষণ, আমার তো মনে হয় স্কুল লেভেল থেকে একটা সাবজেক্ট হিসেবে থাকা উচিত৷ কিন্তু সেই মৌলিক সংস্কারের মতো উদার চিন্তাভাবনা করার সেই থিংকাররা কোথায়, যাঁরা এটাকে ইন্ট্রোডিউস করবেন?’’