নারীর জন্য গণপরিবহণ কতটা নিরাপদ
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮গনমাধ্যমে প্রকাশিত খবর পর্যবেক্ষণ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, গত ১৩ মাসে বাস চালক-হেলপার ও তাদের সহযোগীরা ৯টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ৮টি ধর্ষণ ও ৪টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটিয়েছে৷ এসব ঘটনায় ৫৫ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে৷ এরমধ্যে ৯ এপ্রিল মানিকগঞ্জে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি৷ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণও দিয়েছে৷
গত ২১ জানুয়ারি রাজধানীর দারুসসালামে চলন্ত বাসে যৌন হয়রানির অভিযোগে গাবতলী-নবিনগর রুটের বাসচালক ও হেলপারের বিরুদ্ধে দারুসসালাম থানায় মামলা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী৷ এই ঘটনায় পুলিশ চালক ও হেলপারকে আটক করেছে৷
২০১৭ সালের ১৩ মার্চ ইজিবাইকে করে চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে আলমডাঙ্গায় ফিরছিলেন এক স্কুল ছাত্রী৷ ইজিবাইকের ভাড়া মেটাতে না পারার অজুহাতে চালকসহ চার জনের ধর্ষণের শিকার হন ওই স্কুল ছাত্রী৷
সে বছরেরই ৯ এপ্রিল ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এসআই পরিবহনের চলন্ত বাসে স্বামীর সামনে এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷
৩১ জুলাই কুড়িগ্রামের রৌমারীতে পদ্মা পরিবহনের একটি বাসে ঢাকা আসার পথে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় এক কিশোরী গৃহকর্মী৷
এক মাস পর, অর্থাৎ গত আগষ্টে গাজীপুর থেকে নারায়নগঞ্জ আসার পথে ট্রাকের চালক মেহেদী হাসান ও হেলপার সোহান মিলে এক কিশোরীকে চলন্ত ট্রাকে ধর্ষণ করে৷ পরে পুলিশ ট্রাকের চালককে আটক করে৷
আগষ্টেই রাজধানীর বনানীতে এক তরুণীকে প্রাইভেট কারে তুলে নিয়ে যৌন হয়রানির চেষ্টা চালায় ইমরান হোসেন নামের এক ব্যক্তি৷ এই ঘটনায় ইমরানরকে গ্রেপ্তার ও গাড়িটি জব্দ করে পুলিশ৷
আগস্টেরই আরেক ঘটনা৷ ১১ আগষ্ট ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় লেগুনার চালক জয়নাল আবেদিন ও হেলপার রিপন ওই এলাকার ৭ম শ্রেণির এক মাদ্রাসা ছাত্রীকে ধর্ষণ করে৷ ছাত্রীর চাচা বাদী হয়ে মামলা করলে পুলিশ চালক ও হেলপারকে আটক করে৷
দু' সপ্তাহের মধ্যেই ঘটে ধর্ষণের আরেকটি ঘটনা৷ ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহে যাওয়ার পথে টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় চলন্তবাসে জাকিয়া সুলতানা রুপা নামে এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়৷
এরপর ১২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে লোহাগাড়া যাওয়ার পথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে বাসে এক গৃহবধুকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে বাসের চালক জনি বডুয়া ও হেলপার মো. এহসানকে আটক করে ভ্রাম্যমান আদালত এক বছরের কারাদণ্ড দেয়৷
২৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে বহদ্ধারহাটে যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে চালক রাশেদুল ইসলাম ও সহকারি ইমতিয়াজ উদ্দীন এক তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে৷ তরুণী থানায় মামলা করলে পুলিশ ওই দু'জনকে আটক করে৷
৩ নভেম্বর, রবিবার গাজীপুর বাইমাইল এলাকায় নৌকায় তুলে এক পোশাক শ্রমিককে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে চার দুর্বৃত্ত৷ ২১ ডিসেম্বর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আনন্দ পরিবহনের বাসে ৮ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে বাস চালক পারভেজ৷
এর আগে গত বছরের ২২ জানুয়ারি কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে নদীয়ার রেল ষ্টেশনে বাংলাদেশি এক নারী যাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হন৷
একই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীতে বাসের ভেতরে এক নারীকে যৌনহয়রানি করে বাসের চালক ইসমাইল হোসেন ও তার চার সহযোগী৷ ওই বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ভালুকায় বাসে আটকে রেখে ১৩ বছরের এক কিশোরী পোশাককর্মীকে ধর্ষণ করে বাসের হেলপার হাফিজুল ইসলাম৷
এছাড়াও ২১ মে কুড়িল বিশ্বরুটে মাইক্রোবাসে এক গারো তরুণী ধর্ষণের শিকার হন৷ ১৩ মে ময়মনসিংহের চুলখাই এলাকায় বাসচালক ও হেলপার মিলে ধর্ষণ করে এক তরুণীকে৷ ১১ মে ঢাকার অদূরে সোনারগাঁওয়ে বাসের মধ্যে এক তরুণীকে ধর্ষণ করে বাসচালক ও তার সহযোগী, ৩ মে আশুলিয়ার বাস কাউন্টার থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়৷ ওই তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৷ ২৫ এপ্রিল খিলগাঁওয়ে এক গৃহবধুকে মাইক্রোবাসে যৌন নির্যাতনের পর ওই মাইক্রোবাসে চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়৷ ১৯ এপ্রিল ঢাকা থেকে জামালপুরগামী ট্রেনে দুর্বৃত্তদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হন এক নারী৷
যাত্রী কল্যান সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথের ভিত্তিতে এই তথ্য প্রকাশ করেছি৷ আর এইসব ঘটনায় পুলিশ সক্রিয় হয়েছে৷ অভিযোগ বা মামলাও করা হয়েছে৷ কিন্তু আমরা মনে করি, এটা প্রকৃত ঘটনা যা ঘটে তার চেয়ে অনেক কম৷ কারণ, সব ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয় না৷ আবার সবাই নানা কারণে পুলিশের কাছে অভিযোগও করেন না৷''
তিনি বলেন, ‘‘সাধারণত গণপরিবহণের নারী যাত্রীরা নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত৷ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত নারীরা গণপরিবহণ ব্যবহার তেমন করেন না৷ তাই গণপরিবহণে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যায় না৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সমস্যা হচ্ছে, পরিবহণে কোনো নারী যৌন হয়রানির শিকার হলে তিনি কোথায় অভিযোগ করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না৷ এজন্য মোবাইলকোর্ট সক্রিয় করা উচিত৷ রুট অনুযায়ী মোবাইল কোর্টের ফোন নাম্বার গণপরিবহনের প্রকাশ্য স্থানে লিখে রাখতে হবে৷ আর মালিকদের উচিত হবে বাসের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া, মোটিভেশন প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করা৷''
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘নারীদের জন্য আলাদা বাস, যেখানে ড্রাইভার, হেলপার সব নারী হবে, এটা একটা সমাধান হতে পারে৷ কিন্তু এটা হয়তো ঢাকায় হতে পারে, সারাদেশে সম্ভব নয়৷ আর তাতে বাস থেকে নামার পর তাঁদের নিরাপত্তা দেবে কে? তাই সার্বিকভাবে নারীদের নিরাপত্তা জোরদার করা জরুরি৷ সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে৷''
টাঙ্গাইলে চলন্তবাসেরূপা হত্যা এবং ধর্ষণ মামলার রায়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি চার জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত৷ একজনকে দেয়া হয়েছে সাত বছরের কারদণ্ড৷ গত বছরের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে কর্মস্থল ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে জাকিয়া সুলতানা রূপা পরিবহণ শ্রমিদের সংঘদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন৷ বাসেই হত্যার পর মধুপুর উপজেলায় পঁচিশ মাইল এলাকায় বনের মধ্যে রুপার মরদেহ ফেলে দেয়া হয়েছিল৷
মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এবং মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘‘রূপা হত্যা এবং ধর্ষণের বিচার হয়েছে৷ এটা হয়তো আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করে৷ কিন্তু গণপরিবহণে তাতে যৌন হয়রানি কমবে বলে মনে হয় না৷ আমরা এই ধরনের যৌন হয়রানির প্রচুর অভিযোগ পাই৷ আসলে অভিযোগ জানানোর বিষয়টি সহজ করতে হবে৷ কারণ, চলন্ত বাসে ঘটনা কোন থানা এলাকায় তা নিয়ে পুলিশের আইনি দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত অনেক ঘটনায়ই আর অভিযোগ হয় না৷ তাই এইসব ব্যাপারে তাৎক্ষণিক অভিযোগ নেয়ার কোনো একক ব্যবস্থা চালু করতে হবে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘নারীদের জন্য নারী ড্রাইভার ও হেলপার দিয়ে যদি পর্যাপ্ত সংখ্যক বাস নামানো যায়, তাহলে হয়তো কিছুটা সমাধান আশা করা যায়৷ কিন্তু তারপরও সমস্যা থেকে যাবে৷ অভিযোগ দায়ের এবং অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হলে আমি মনে করি, এই ধরনের ঘটনা কমে আসবে৷ আর বাসে নারীদের যে আসন সংরক্ষণের বিধান আছে, তা সঠিকভাবে কার্যকর করতে হবে৷''
বাংলাদেশে গণপরিবহন নারীদের জন্য কতটুকু নিরাপদ? মন্তব্য লিখুন নিচের ঘরে৷