ছায়া দেখে ভয় পেলে চলবে?
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১এই আইনের ভয়ে ভীত গণমাধ্যম৷ প্রশ্ন হচ্ছে, ভয়কে জয় করা কি সম্ভব নয়?
ডয়চে ভেলের সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘কনফ্লিক্ট জোন'-এর উপস্থাপক বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক টিম সেবাস্টিয়ান৷ কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা গওহর রিজভীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তিনি৷ সেখানে এক পর্যায়ে গওহর রিজভীকে সেবাস্টিয়ান বলেন, ‘‘আপনি চাপ প্রয়োগ করে গণমাধ্যমকে নতিস্বীকার করতে এবং চুপ থাকতে বাধ্য করেছেন, ফলে এটি এখন নিজের ছায়া দেখেই ভয় পাচ্ছে৷''
গণমাধ্যমের নিজের ছায়া দেখে নিজেই ভয় পাওয়ার এই বিষয়টি আমাকে বিস্তর ভাবিয়েছে৷ এমন নয় যে এখনই বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে চাপের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে৷ বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে নানা সময়ে নানা শাসক গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করেছে৷ কখনো কখনো তাতে সাময়িক সাফল্য এসেছে, কখনো কখনো শাসকগোষ্ঠীর এই চাপ গণমাধ্যমকে খুব একটা দমাতে পারেনি৷ অর্থাৎ চাপটা কম বা বেশি সবসময়ই ছিল, গণমাধ্যম পুরোপুরি স্বাধীন ছিল এমন সময় আমার জানামতে স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো আসেনি৷
তাহলে বর্তমানে গণমাধ্যমকে দৃশ্যত এতটা ভীতসন্ত্রস্ত মনে হচ্ছে কেন? এক্ষেত্রে আমার নিজের ভাবনার জায়গা থেকে বলতে পারি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এক বড় কারণ৷ এই আইন ব্যবহার করে সাংবাদিকদের হয়রানি করার সুযোগ যথেষ্টই রয়েছে৷ খোদ গওহর রিজভীও স্বীকার করেছেন আইনটিতে কিছু ‘শব্দচয়ন দুর্বল এবং অস্পষ্ট' যার অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে৷
আমি মনে করি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এই দুর্বলতা সম্পর্কে সরকার অবগত এবং এটা ইচ্ছাকৃতভাবেই এভাবে রাখা হয়েছে৷ অন্যথায় বর্তমান সরকারের পক্ষে আইনটি সংশোধন করে সেটির দুর্বলতা দূর করা মোটেই কঠিন কিছু নয়৷ এটা করতে গেলে সরকারের কোনো বাধার মুখে পড়ার কথা নয়৷
আর সেটা না করায় এই আইনের অপব্যবহারের নানা উদাহরণ আমরা মাঝেমাঝেই পাই৷ বাকস্বাধীনতা বিষয়ক সংগঠন আর্টিকেল ১৯-এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত বছর ৪৫৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, যার মধ্যে ৭৫ জনই সাংবাদিক৷ খোঁজ নিলে দেখা যাবে এই সাংবাদিকদের অধিকাংশই আইনের গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন তথাকথিত ‘সরকারবিরোধী' লেখালেখি করে কিংবা কার্টুন এঁকে বা ফেসবুকে কিছু পোস্ট করে৷
এখন, ‘সরকারবিরোধী' বিষয়টি যে কী সেটা নিয়েও বিস্তর আলোচনা করা যায়৷ আপাতদৃষ্টিতে যা কিছু সরকারের বিপক্ষে যায় তার সবকিছুকেই আপনি সরকারিবরোধী তকমা দিতে পারেন৷ সেটা হতে পারে কোনো দুর্নীতি নিয়ে কথা বলা কিংবা নেহাত সরকারের কোনো একটি বিষয় যা আপনার হয়ত ভালো লাগেনি বলে কড়া ভাষায় কিছু লিখেছেন, সেটাও৷
কথা হচ্ছে, সরকারের বিরোধিতা কেন করা যাবে না? একজন ব্যক্তির যদি সরকারের কিছু ভালো না লাগে, সেটা তিনি কেন বলতে পারবেন না? একজন প্রধানমন্ত্রী যদি সমালোচিত হওয়ার মতো কিছু করেন, সেটার সমালোচনা করতে বাধা থাকবে কেন? এমন সমালোচনার জন্য একটি শিশুকে জেলে যেতে হবে কেন? কেন একজন আলোকচিত্রী বা কার্টুনিস্টকে মাসের পর মাস কারাভোগ করতে হবে?
এরকম প্রশ্ন অজস্ত্র করা যায়৷ সহজ করে বললে, এগুলো করা হয় ভয় সৃষ্টির জন্য, যে ভয়ে ভীত হয়ে সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ সবাই নিজেকে গুটিয়ে নেবে৷ আর যত মানুষ নিজেকে গুটিয়ে নেবে শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে ততই নিজেকে জবাবদিহিতা থেকে দূরে রাখা সহজ হবে৷ মোটা দাগে বাংলাদেশের বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতিকে এভাবে মূল্যায়নের সুযোগ রয়েছে৷
তবে আমি মনে করি, এই ভয়কে জয় করার কথাও ভাবতে হবে গণমাধ্যমকে৷ আর এজন্য নানা পন্থা নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে৷ নিজের ছায়া দেখে যে নিজেই ভীত নয় তা গণমাধ্যমকে জানান দিতে হবে৷ সেটা না করে নিজেদের গুটিয়ে নিলে সাধারণ জনগণই বঞ্চিত হবে৷ আর গণমাধ্যমের গুরুত্ব ক্রমশ কমতে থাকবে৷ সেটা গণমাধ্যমের জন্য যেমন ক্ষতিকর, ক্ষতিকর গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার জন্যও৷