নিজের জালেই কি ফাঁসলেন রাহুল?
৩১ মার্চ ২০২৩২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময় কর্ণাটকে গিয়েকংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী একটি মন্তব্য করেছিলেন। তারই জেরে ২০২৩ সালে এসে, আদালতের নির্দেশে তার হাজতবাসের নির্দেশ হয়েছে। একই সঙ্গে তার সাংসদ পদও বাতিল হয়েছে। যা নিয়ে ভারতে তো বটেই, গোটা ভারতীয় উমহাদেশেই আলোচনা হচ্ছে, চলছে বিতর্ক।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রধান অভিযোগ ছিল, ফ্রান্সের কাছ থেকে রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। এই অভিযোগকে সামনে রেখেই কংগ্রেস গোটা ভারতজুড়ে প্রচার চালায়। বস্তুত, তেমনই এক প্রচারে কর্ণাটকে গিয়েছিলেন রাহুল। সেখানে গিয়ে তিনি বলেন, ''সব চোরদের পদবি মোদী হয় কেন?'' মনে রাখতে হবে, এর কয়েকবছর আগে আইপিএল কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ললিত মোদী দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। এর কিছুদিন আগেই ঋণখেলাপের মামলায় অভিযুক্ত হন নীরব মোদী। তিনিও ফেরার। এই নামগুলি উল্লেখ করেরাহুল যখন মোদী পদবিটি নিয়ে তির্যক মন্তব্য করেন, তখন বোঝাই যায় যে, তার লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যদিও রাহুল একবারের জন্যেও প্রধানমন্ত্রীর নাম উচ্চারণ করেননি।
রাহুলের ওই মন্তব্যের পরেই গুজরাতের বিজেপি নেতা পূর্ণেশ মোদী রাহুলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পূর্ণেশের মামলা যে রাজনৈতিক, ভারতের রাজনৈতিক সমাজ তা বিলক্ষণ জানে। কিন্তু আইনের ভাষা রাজনীতির ভাষার সঙ্গে মেলে না। ভারতীয় সংবিধান স্পষ্ট করে বলেছে, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি নিয়ে অবমাননাকর অথবা অপমানজনক কোনো মন্তব্য করা যাবে না। করলে নির্দিষ্ট ধারায় তাকে শাস্তি পেতে হবে। আইনের সেই ৪৯৯ এবং ৫০০ ধারাতেই রাহুলের বিরুদ্ধে মামলা হয়। যেখানে অভিযোগ করা হয়, রাহুল একটি নির্দিষ্ট পদবীর উল্লেখ করে সেই গোষ্ঠীকে অপমান করেছেন। গুজরাতের আদালত সেই আইনেই রাহুলকে দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং দুই বছরের হাজতবাসের নির্দেশ দিয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধি দুই বছরের সাজা পেলে তার সাংসদ বা এমপি পদ খারিজ হয়। রাহুলের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।
বিতর্কের বিষয় হলো, এক্ষেত্রে কি আইনকে হাতিয়ার করে একটি সংকীর্ণ রাজনীতির চাল চালা হলো? বিরোধী রাজনীতিকেরা শাসক বিজেপির বিরুদ্ধে এই অভিযোগই তুলছে। রাহুল গান্ধী মাপের কোনো নেতাকে যখন এই মর্মে শাস্তি দেওয়া হয় এবং সাংসদপদ ছিনিয়ে নেওয়া হয়, তখন এই বিতর্ক উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন উঠছে, একে কি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বাকস্বীনতায় চূড়ান্ত হস্তক্ষেপ বলে গণ্য করা হবে না?
সত্তরের দশকে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল। ভারতীয় সংবিধান এবং আইন মেনেই তা ঘোষণা করা হয়েছিল। এবং বিরোধী নেতা থেকে সাংবাদিক-- বিরোধী স্বরকে নির্বিচারে জেলে ঢোকানো হয়েছিল। আইন ভেঙে নয়, আইন মেনেই তা হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, আইনের অপব্যবহার হয়েছিল। রাহুলের ক্ষেত্রেও কি সেই একই ঘটনা ঘটল?
কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা এবং সাবেক প্রদেশ সভাপতি আব্দুল মান্নান মনে করেন, ''জরুরি অবস্থার সঙ্গে এই সময়কে তুলনা করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। জরুরি অবস্থা কিছু নির্দিষ্ট কারণে ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই সময়ের নিরিখে তা ছিল অনিবার্য। বর্তমান শাসক সব কিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছে। রাহুলের সঙ্গে যা হয়েছে, তা অভূতপূর্ব।''
মান্নানের বক্তব্য, বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক ফ্যাসিস্টের মতো কাজ করছে। রাহুল সেই অর্থে কোনো অন্যায় করেননি।
একটি পদবিকে সরাসরি 'চোর' বলে দেওয়া কি অন্যায় নয়? অবমাননাকর নয়? রাহুল গান্ধীর হয়ে আদালতে লড়াই করছেন কিরিত পানওয়ালা। প্রবীণ এবং বিচক্ষণ এই আইনজ্ঞের মতে, রাহুল কোনো অন্যায় করেননি। রাজনৈতিক বক্তৃতায়, বিশেষ করে নির্বাচনী সভায় কথাচ্ছলে এমন অনেক কথা চলে আসে, যা সাধারণত ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয় না। রাহুলের ওই মন্তব্যও ছিল একটি হাল্কা উক্তি। বস্তুত, ওই মন্তব্য থেকে স্পষ্ট নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণ করার জন্যই তিনি ওইভাবে বাক্যগুলিকে সাজিয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদী এর বিরুদ্ধে আদালতে যেতেই পারেন। ব্যক্তিগত আক্রমণের জন্য রাহুলের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকতেই পারেন। কিন্তু তা ব্যক্তিগতভাবে মোদীকেই করতে হতো। পূর্ণেশ তা মোদীর হয়ে করে দিতে পারেন না।
বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসু কিরিতের এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত নন। তার বক্তব্য, ''রাহুলের মাপের একজন নেতা যখন জনসভায় কথা বলেন, তখন তিনি একটি পদবি নিয়ে এমন অপমানজনক মন্তব্য করতে পারেন না। আদালত সে কথাই বলেছে এবং তার বিরুদ্ধে শাস্তি ঘোষণা করেছে।'' সায়ন্তনের আরো বক্তব্য, এর সঙ্গে বাকস্বাধীনতার কোনো সম্পর্ক নেই। বাকস্বাধীনতার নামে কেউ যা খুশি তাই বলতে পারেন না।
তৃণমূলনেতা ডেরেক ও'ব্রায়েনের বক্তব্য, ''বিজেপি আসলে বিরোধীশূন্য ভারত তৈরি করার চেষ্টা করছে। রাহুলের বিরুদ্ধে শাস্তি এবং তাকে সাংসদপদ থেকে সরিয়ে দেওয়া তার অন্যতম উদাহরণ।''
প্রবীণ রাজনীতি বিশ্লেষক এবং সাংবাদিক দীপ্তেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী মনে করেন, সাম্প্রতিক এই বিতর্কটিকে বিভিন্ন পরতে বুঝতে হবে। এটিকে একরৈখিকভাবে দেখলে হবে না। দীপ্তেন্দ্রর মতে, ''রাহুল আসলে নিজের জালেই ফেঁসেছেন। মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় সাংসদপদ খারিজের এই আইনটির বিরুদ্ধেই অর্ডিন্যান্স জারি করেছিলেন। রাহুল যা সর্বসমক্ষে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।'' দীপ্তেন্দ্র মনে করেন, শাসক হিসেবে বিজেপি সেই খেলাটাই খেলছে, যা তাদের খেলার কথা ছিল। রাহুলের এই ঘটনার পরে কংগ্রেস এবং বিরোধীরা আন্দোলন গড়ে তোলার একটা পথ খুঁজে পেয়েছে। এখন দেখার আগামী লোকসভা ভোট পর্যন্ত তারা তা ধরে রাখতে পারে কি না! কারণ অদূর অতীতে এমন সম্ভাবনা তৈরি হয়েও শেষপর্যন্ত তা ফলপ্রসূ হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, কেন্দ্র এবং রাজ্যে যে যেখানে ক্ষমতায় আছে, সে-ই বিরোধীর কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধীদের সঙ্গে একই কাজ করছেন। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর সরকার সেই একই পথে হাঁটছে। বাকস্বাধীনতা রোধ করার চেষ্টা সর্বত্র। বিরোধীকে সেখান থেকেই নিজেদের স্বর তৈরি করতে হবে। কেন্দ্রেও। রাজ্যেও।