ভারতে মাংস খাওয়ার প্রবণতা
২১ জানুয়ারি ২০১৩পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে নিরামিষ ভোজীর হার ৪০ শতাংশ৷ এই দিক দিয়ে বিশ্বের সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে ভারত৷ কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে অন্যরকম হাওয়া বইতে শুরু করেছে সেখানে৷
ফাস্ট ফুডের বিস্তার
বিশেষকরে শহরগুলিতে ফাস্ট ফুড রেস্তোঁরা গজিয়ে উঠছে যেন ছত্রাকের মতো৷ আলোকোজ্জ্বল বিজ্ঞাপন দিয়ে বিশেষ করে তরুণদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে তারা৷ দিল্লি, মুম্বই ও কলকাতার মতো বড় বড় শহরগুলিতে সপ্তাহান্তে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে সেসব খাওয়ার জায়গায়৷ পরিবার পরিজন নিয়ে কোকাকোলা, বার্গার ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়ার ধুম পড়ে যায়৷ এ প্রসঙ্গে নতুন দিল্লির ডায়বেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. সঞ্জয় সানাধ্যায় বলেন, ‘‘ভারতের মানুষরা পশ্চিমা বিশ্বের জীবনধারা অনুকরণ করছে চিন্তাভাবনা না করেই৷ লক্ষ্য করা যায়, কীভাবে তারা নিজের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে৷ এছাড়া বিশ্বায়নের এই যুগে বিভিন্ন দেশে যাতায়াত বেড়ে যাওয়ার কারণেও মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলাচ্ছে৷''
ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি, বিশেষ করে অল্পবয়সীরা মাংস খাওয়াকে মুক্ত মনের পরিচায়ক বলে মনে করে৷ এছাড়া মাংসের পদ নিরামিষের চেয়ে দামি বলে এক ধরনের বিত্ত বৈভবের পরিচয়ও তুলে ধরে তারা৷
রক্ষণশীলতা কাটিয়ে উঠছে তরুণরা
তরুণ ছাত্র যসপ্রিত সিং অনেক বছর ধরেই মাছ মাংস খাচ্ছেন৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমি শরীরের জন্য যথেষ্ট প্রোটিন গ্রহণ করার চেষ্টা করি৷ মুরগি ও ভেড়ার মাংস এবং মাছ খাওয়ার অভ্যাস আছে আমার৷ সব সময় স্বাদের না হলেও আমি সব কিছুই চেখে দেখতে চাই৷ সবাইকে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা উচিত৷''
সহপাঠী নেহা চৌহান নিরামিষাশী হলেও তার বোন ও বাবা মাংস খান৷ নেহা জানান, ‘‘আমার বোন দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে৷ তাই তার সে সব জায়গার সঙ্গে তাকে খাপ খাইয়ে চলতে হয়৷ আমাকে এটা করতে হয়নি৷ আমাকে অন্য কোনো দেশে বসবাস করতে হলে সেখানকার সমাজের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে হয়তো মাংসও খেতে হতো৷''
ধর্মীয় বিধিনিষেধ
অন্যদিকে, মাংস খাওয়ার ব্যাপারে নানা রকম ধর্মীয় বিধিনিষেধও রয়েছে৷ ভারতের ৮০ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী৷ তারা গরুর মাংস খান না, মুসলমানরা শুয়োরের মাংস থেকে দূরে থাকেন৷ ম্যাক ডোনাল্ডস-এর মতো ফাস্ট ফুড রেস্তঁরাগুলিতে ভারতীয় সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে গরুর মাংসের বার্গার বিক্রি করা হয় না৷ তার বদলে পরিবেশন করা হয় ‘চিকেন মহারাজা বার্গার'-এর মতো বার্গার৷ বিজ্ঞাপনে বলা হয়, এইবার্গার খেলে নিজেকে মহারাজার মতোই মনে হবে৷
এইভাবে এইসব রেস্তোঁরা বলিউড বা ক্রিকেট তারকাদের নিয়ে প্রচারণা চালিয়ে বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করে৷ তৈলাক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবারের পাশাপাশি শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণও কমে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে৷ যেমন অফিসে চেয়ারে বসেই কাজ করতে হয় অনেকটা সময়, খেলাধুলা ও স্বাস্থ্যকর খাবারের সুযোগ সুবিধাও কম৷ পুষ্টিকর খাদ্য দ্রব্য ও রান্নাবান্নার সময়ও পান না অনেকে৷ একটু স্বচ্ছল হলেই গাড়ি কেনার প্রবণতা থাকে৷ ঘরকন্নার সাহায্যে থাকে কাজের লোকজন৷
‘লাইফ স্টাইল' নিয়ে সমস্যা, রোগের প্রকোপ
এর ফলে দেখা দিচ্ছে নানা রকম রোগ ব্যাধি৷ চিকিত্সক ও ডায়বেটিস বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় সানাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘লাইফ স্টাইল-এর একটা বিরাট প্রভাব পড়ছে মানুষের উপর৷ যেমন হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, ডায়বেটিস, স্ট্রোক ইত্যাদি রোগ ব্যাধি আগের চেয়ে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে৷ গত তিন দশকে এইসব রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা যেন এক লাফে তুঙ্গে উঠেছে৷ আমার ধারণা অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবে৷''
এমনিতেই ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ম্যালেরিয়া, পোলিও, যক্ষ্মা, লেপ্রা ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে৷ স্বাস্থ্য বিমা এখনও বেশির ভাগ মানুষের দ্বারে পৌঁছাতে পারেনি৷ তার ওপর হৃদরোগ, বহুমূত্র ও উচ্চরক্তচাপের মতো অসুখ বিসুখের হার বৃদ্ধি পেতে থাকলে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে হিমশিম খেতে হবে৷
গবেষক ও চিকিত্সক ড . কে . কে . আগরওয়াল এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, ‘‘ভারতে ডায়বেটিস রোগটি মহামারির আকার নিতে থাকলে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অন্ধ, হৃদরোগও অঙ্গহীন মানুষের বাসস্থান হবে দেশটি৷ দুর্ভাগ্যবশত এখন পর্যন্ত ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণের তেমন কোনো কর্মসূচি নেই ভারতে৷ হৃদরোগের রক্ত সঞ্চালন ও মেদ জনিত অসুখ বিসুখের ব্যাপারে কিছু কিছু প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হলেও এক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে৷ আর তা না হলে এ ব্যাপারে পরিবর্তন আসবে না৷''