নির্বাচনই টার্গেট বিএনপি'র
১৮ মার্চ ২০১৮খালেদা জিয়া গত ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যাওয়ার আগের দিন স্থায়ী কমিটির বৈঠক করেন৷ ওই বৈঠকে দলের পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে তিনি কিছু নির্দেশনা দেন৷ তাতে আগামী নির্বাচনে দলের শরীকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনো কথা হয়নি৷
তখন সিদ্ধান্ত হয় দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর বৈঠক করে আসন ভাগাভাগি এবং জোটগত নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে৷ তবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দলের নেতা-কর্মীদের বলা হয়৷ বলা হয়েছে, কেন্দ্র থেকে সবুজ সংকেত দেয়ার পর নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করতে হবে৷
জানা গেছে, বিএনপি থেকে প্রার্থিতার ব্যাপারে আগাম একটা সিগন্যাল দেয়া আছে অনেককেই৷ কারা প্রার্থী হলে কেমন করবে তা নিয়ে বিএনপি এর আগে অন্তত দু'টি জরিপ করিয়েছে বিদেশি প্রতিষ্ঠান দিয়ে৷ বিএনপি জরিপের কথা স্বীকার করলেও কাদের দিয়ে সেই জরিপ করিয়েছে তা অবশ্য প্রকাশ করেনি৷
বিএনপি এখন আন্দোলন এবং নির্বাচন নিয়ে একসঙ্গে কাজ করছে৷ তারা খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনকে নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবেই নিয়েছে৷ আর এই আন্দোলনকে তারা এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণই রেখেছে৷
জানা গেছে, এর মধ্যে খালেদা জিয়া যদি মুক্তি না পান তাহলে আগামী জুন পর্যন্ত বিএনপি এই ধারাতেই আন্দোলন চালিয়ে যাবে৷ জুনের পর বিএনপি তাদের আন্দোলনের গতি আরো বাড়াবে৷ তবে সেটাও শান্তিপূর্নই রাখার নির্দেশনা আছে৷ কারণ বিএনপি চায় বিএনপি'র নেতা-কর্মী যারা বাইরে আছেন তাদের যেন সরকার আটেকের কোনো ‘অজুহাত' না পায়৷
বিশেষ করে সংসদীয় আসনগুলোতো বিএনপি'র যারা সম্ভাব্য প্রার্থী তারা যেন মুক্ত থাকতে পারেন৷ তাদের যদি নির্বাচনের আগে কারাগারে যেতে হয় তাহলে বিএনপি'র অন্য নেতা-কর্মীদের নির্বাচনের মাঠে পাওয়া কঠিন হবে৷ একই সঙ্গে বিএনপি দলে এবং স্থানীয় পর্যায়ে কারা ‘বিদ্রোহী' হতে পারে সেদিকেও খেয়াল রাখছে৷
বিএনপি মনে করে, নির্বাচনে তাদের ভোট ব্যাংক অক্ষুন্ন থাকবে৷ একই সঙ্গে বিএনপি'র প্রতি সহানুভূতির ভোটও বাড়বে৷ কিন্তু নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী দেয়া না যায় তাহলে পরিস্থিতি ভিন্নও হতে পারে৷ তাই এখন বিএনপি চাইছে সম্ভাব্য যোগ্য প্রার্থীদের যেন গ্রেপ্তার এড়িয়ে কারাগারের বাইরে রাখা যায়৷
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট এবং প্রতিরোধ করতে গিয়ে বিএনপি এখন সংসদেও নেই৷ আর আগে তারা অন্তত সংসদে ছিল৷ দলটি এক যুগের মত ক্ষমতার বাইরে৷ তাই নেতা-কর্মীরা হতাশ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন৷ এবার নির্বাচনই নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা ও ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ করে দেবে৷ আর এই ট্রেন মিস করলে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে আরো সংকটে পড়বে৷ নির্বাচন বর্জন করলে দলের নেতা-কর্মীদের একটি অংশকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে৷ অনেকে স্বতন্ত্র হিসেবে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন এমন আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ৷
সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপি'র কার্যকরী কমিটির সদস্য এবং ইউপি চেয়ারম্যান ফুল মিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরাতো ম্যাডাম খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যেতে পারিনা৷ আর কেন্দ্র থেকে এখন ম্যাডামের মুক্তির আন্দোলনের কথাই বলা হচ্ছে৷ তবে নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতিই আমাদের আছে৷ কেন্দ্র যে রকম সিদ্ধান্ত দেয় আমরা সেরকম কাজ করব৷ কিন্তু আমাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি আছে৷ আমি সুনামগঞ্জের কথা বলতে পারি৷ এখানকার ২-৩ জন প্রার্থী প্রস্তুত আছেন৷ শেষ মুহূর্তেও যদি কেন্দ্র নির্বাচনের সিগন্যাল দেয় তাহলে আমাদের নির্বাচনে অসুবিধা হবেনা, এবং বিএনপি'র প্রার্থী পাশ করবে বলে আশা করি৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘সারা দেশেই যারা বিএনপি'র সম্ভাব্য প্রার্থী তারা নেতা-কর্মীদের নিয়া মাঠে আছেন৷ তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷ তারা যে কোনো সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছেন৷ যদিও বিএনপি'র তুনমূলের নেতা-কর্মীরাই এখন টার্গেট৷ তাদের আটকের জন্যই নানা তৎপরতা চলছে৷ তবে এসব কোনো ব্যাপার না৷ নির্বাচনের সিগন্যাল পেলে সবাই মাঠে নামবে৷ সবাই প্রস্তুত আছে৷''
বিএনপি'র এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘বিএনপি মনে করে সরকার যতই চেষ্টা করুক না কেন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতেই হবে৷ আর নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে সরকারের প্রভাব ততই কমবে৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তত সক্রিয় হবে৷ ২০১৪ সালের মত একতরফা নির্বাচন এবার আর সম্ভব হবেনা৷ তাই বিএনপি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবীতে মাঠে নেমেছে নির্বাচনকেই টার্গেট করে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘এরমধ্যে খালেদা জিয়া মুক্তি না পেলে জুন মাস থেকে চলমান আন্দোলনের গতি বাড়বে৷ আর মুক্তি পেলেও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামবে বিএনপি৷ সরকারকে চাপে রেখেই নির্বাচনে যাবে বিএনপি৷ বিএনপি'র টার্গেট হল যতটা সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে নির্বাচন করা যায়৷''
বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা স্পষ্ট যে বিএনপি যাতে নির্বাচনে আসতে না পারে সেজন্য সরকার নানা নীলনকশা প্রণয়ন করছে৷ আর সেজন্যই একটি ভুয়া মামলায় বিএনপি'র চেয়ারপার্সন এবং তিন বারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠিয়েছে৷ জামিন দেয়া নিয়ে নানা টালবাহানা করছে৷ প্রতিদিন বিএনপি'র নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে৷ তাদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে৷ সরকার চায় বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে ২০১৪ সালের মত আরেকটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করতে৷''
তাহলে বিএনপি কী করবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘খালেদা জিয়া আগেই ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেছেন৷ তিনি বলেছেন, বিনপিকে যদি জনগণ ভোট দেয়, বিএনপি যদি ক্ষমতায় যায় তাহলে এই ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়ন করবে৷ খালেদা জিয়া বলেছেন আগামী নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে৷ আমরা এখন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেইং ফিল্ডের জন্য আন্দোলন করছি৷ আশা করছি খালেদা জিয়া নির্বাচনের আগে মুক্তি পেয়ে একটি রূপরেখা দেবেন৷ আর সেই রূপরেখা অনুযায়ী একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছি৷ দেশের জনগণ নির্বাচন চায়৷ বিএনপিকে ভোট দিতে চায়৷ আমরাও জনগণের দল হিসেবে নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত আছি৷''
এদিকে, জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন হলেও জামিনের বিরুদ্ধে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করায় তিনি এখনো কারাগারে আছেন৷ রবিবার আপিল বিভাগে এর শুনানি শেষ হয়েছে৷ সোমবার আদেশ দেয়া হবে৷ তবে কুমিল্লার আরেকটি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে৷
আপনিও কি মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী আন্দোলন করছে? লিখুন নিচের ঘরে৷