নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে অনড় হাসিনা
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারি৷ সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন হবে৷ সে হিসেবে আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে ভোট হতে হবে৷ আর তফসিল সাধারণভাবে নির্বাচনের ৪০-৪৫ দিন আগে হয়৷ ফলে তফসিল ঘোষণা হতে পারে নভেম্বরেই৷
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে আলাদা করে কিছু বলা নেই৷ তারপরও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়েছিল৷ সরকারের মন্ত্রিসভা ছোট করা হয়েছিল৷
ওই সময়ের নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধানমন্ত্রীসহ ২২ জন মন্ত্রী ও সাতজন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন৷ নতুন আটজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী নেয়া হয়৷ আর ১৬ মন্ত্রী ও ১৪ প্রতিমন্ত্রী পদত্যাগ করেন৷ তবে এর আগেই সবার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাখা হয়েছিল৷ বিএনপিকে এই নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নেয়ার আহ্বান জানানো হলেও তারা তা প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন বয়কট করে৷
এবারের নির্বাচনের জন্যও তিন মাসের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তুতি চলছে৷ জানা গেছে ২০১৪ সালের মতই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই সরকার গঠিত হবে৷ মন্ত্রিসভার আকার ছোট হবে৷
শুক্রবার নিউইয়র্কে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘আগামী সাধারণ নির্বাচনের সময় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সরকার গঠন করা হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমি বিরোধী দলীয় নেত্রীর (রওশন এরশাদ) সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছি৷ তারা যদি চান আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেন৷''
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘‘সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সকল রাজনৈতিক দল যদি চায় তাহলে আমরা তাদের প্রতিনিধি নিয়ে সরকার গঠন করতে পারি৷ তারা ক্ষমতাসীন অথবা বিরোধী দল কিনা সেটা কোন বিষয় না৷ তবে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে কোনো সংজ্ঞা নেই৷''
সংবিধানের ৫৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনোকিছুই অযোগ্য করিবে না৷''
আর ৫৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘‘প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিলে বা স্বীয় পদে বহাল না থাকিলে মন্ত্রীদের প্রত্যেকে পদত্যাগ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে; তবে এই পরিচ্ছেদের বিধানাবলী-সাপেক্ষে তাহাদের উত্তরাধিকারীগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাহারা স্ব স্ব পদে বহাল থাকিবেন৷''
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর থেকেই বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল৷ এই দাবিতেই বিএনপি ও তার শরিকরা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে৷
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা আমাদের আগের দাবিতেই অটল আছি৷ কেনো দলীয় সরকারের অধীনে নয়, নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে৷ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনই প্রমাণ করে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের কথা বলে আমাদের হাইকোর্ট দেখাচ্ছেন৷ এই সরকারের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই৷ বৈধতা নেই৷ তাই সংবিধানের দোহাই দিয়ে কোনো লাভ নেই৷ তারা ৫ জানুয়ারির যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আছেন ওই নির্বাচন কোনো বৈধ নির্বাচন না৷ তাই তারা এতদিন যে কষ্ট দেশের মানুষকে দিয়েছেন তা থেকে রেহাই দেয়া উচিত৷''
এরই মধ্যে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া যে ৫ দফা দাবি দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, নির্বাচনকালীন সরকারে যাঁরা থাকবেন, তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না৷ ৩০ অক্টোবরের মধ্যে তাদের দাবি মেনে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নতুন এই জোট৷
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক এবং যুক্তফ্রন্টের অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটাতো প্রধানমন্ত্রী তাঁদের কথা বলেছেন৷ আমাদের কথাতো বলেননি৷ ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের মত একটা বিতর্কিত, থার্ড ক্লাস নির্বাচন এদেশে আর কখনো হয়নি৷ এই নির্বাচন কেউ গ্রহণ করেনি৷ এই সংসদে আবার বিরোধী দলের অর্ধেক আছে সরকারের সঙ্গেই৷ তিনি যা বলেছেন তা কোনো নীতি বা সংবিধানের কথা না৷ এটা মানবার কোনো প্রশ্ন ওঠেনা, অবকাশও নেই৷ উনি বলেছেন, উনি যেরকম ভাবেন সেরকম৷ এটা বাংলাদেশের জনগন মানবেনা, প্রত্যাখ্যান করবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা যেটা বলেছি সেটাই যৌক্তিক৷ একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে যারা অংশীজন তাদের বাদ দিয়ে তো হবেনা৷ তাঁরা তাঁদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যদি নির্বাচনকালীন সরকারের যৌক্তিকতা মেনে নেয়, তাহলে সেটা প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব মতো নয়, আমরা যেভাবে বলেছি সেভাবে হতে হবে৷''
আর সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি কেনো উঠছে? উঠছে এই কারণে যাতে নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীনরা নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে৷ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে না পারে৷ এখন যদি কথিত বিরোধী দল নিয়ে এই সরকারের অধীনেই ছোট আরেকটি নির্বাচনকালীন সরকার হয় তাহলে তো নির্বাচনে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাবেনা৷''
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি৷ যাঁরা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করেছে তাঁরাই আবার ক্ষমতায় এসেছে৷ তাঁরা নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং আইন-শৃংখলা বাহিনীকে প্রভাবিত করে তাঁদের কাজে লাগিয়েছে৷ তাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার নির্দলীয় হওয়া প্রয়োজন৷''