নির্ভয়ার ধর্ষকদের ফাঁসি নিশ্চিত
৫ মে ২০১৭‘১৬ ডিসেম্বর-২০১২, দিল্লির কনকনে শীতের সন্ধ্যায় সাকেত পিভিআর সিলেক্ট সিটি ওয়াক মলে বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন ২৩ বছরের প্যারা মেডিকেল ছাত্রী৷ সিনেমা দেখে বেরোনোর পর বাসে চড়তেই তাদেঁর জীবনে কতটা অন্ধকার নেমে আসতে চলেছে তার আন্দাজ ছিল না মেয়েটির'— চূড়ান্ত রায়ে এই ভাবেই নির্ভয়া-কাণ্ডে চার দোষীর অমানবিক নির্মমতা বর্ণনা করে তাদের ফাঁসির সাজা বহাল রাখল ভারতের সর্বোচ্চ আদালত৷ নির্ভয়ার প্রতি অত্যাচার এবং অপরাধীদের ফাঁসির সাজাকে ভারতীয় সমাজের নারীর প্রতি সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা এবং গণআন্দোলনের জোয়ারে সমাজের ‘বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছে' বলেও উল্লেখ করা হয়েছে৷ সচরাচর যা হয় না, এদিন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তেমনটাই লক্ষ্য করা গেছে৷ বিচারপতিরা তাঁদের রায়ে সেদিনের সেই ভয়াবহ রাতের নারকীয় ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ উল্লেখ করেছেন৷ একইসঙ্গে দেশে নারী নির্যাতন বন্ধ হওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন৷ রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল হর্ষধ্বনি ওঠে আদালত কক্ষের ভেতরেই৷
মোট ৪২৯ পাতার দুটি রায়ে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি দীপক মিশ্র ও বিচারপতি অশোক ভূষণ একটি রায় দিয়েছেন, পাশাপাশি বেঞ্চের অপর বিচারপতি আর ভানুমতী পৃথক একটি রায় দিয়েছেন৷ তবে, তাঁদের রায়ে কোনও মতপার্থক্য হয়নি৷ দিল্লি হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে দোষী মুকেশ সিংহ, পবন গুপ্ত, বিনয় শর্মা ও অক্ষয় ঠাকুরের ফাঁসির নির্দেশ দিয়েছেন তিন বিচারপতিই৷ ১৯৯৪ সালে কলকাতার ধনঞ্জয় চ্যাটার্জির ফাঁসির ঘটনা-সহ একাধিক মামলার উদাহরণ দিয়ে নির্ভয়াকাণ্ডকে ‘অমানবিক অপরাধ', ‘নিকৃষ্টতম আচরণ' এবং ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম' ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন বিচারপতিরা৷
দিল্লি হাইকোর্টের ফাঁসির নির্দেশের বিরুদ্ধে দোষীরা সুপ্রিম কোর্টে যে আর্জি জানিয়েছিল, তা খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ রায় ঘোষণার শুরুতেই বিচারপতি মন্তব্য করেন, ‘‘‘এক ভয়াবহ অন্ধকার সময়ের মধ্যে আমরা রয়েছি৷''
রাম সিংহ (বাসের চালক) নামে এক অভিযুক্ত তিহার জেলে রহস্যজনকভাবে মারা যায়৷ এই মামলার ষষ্ঠ অভিযুক্ত, যে অপরাধের সময় নাবালক ছিল, আগেই তাকে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড তিন বছরের জন্য সংশোধনাগারে পাঠিয়েছে৷ তবে ২০১৫-র নভেম্বরে সে ছাড়া পায়৷ যে ৪ জনের ফাঁসির সাজা ঘোষণা হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে পারিবারিক অসহায়তা, অজ্ঞতা এবং দারিদ্রতার কারণ দেখিয়ে কম শাস্তির আবেদন জানানো হয়েছিল৷ আদালত সেই আর্জির উত্তরে বলেছে, ‘‘দোষীদের পরিচিতি, সামাজিক পরিস্থিতি, বয়স বা অপরাধের পূর্ব নজির না থাকা, জেলে ভালো আচরণ এসবের কোনওটির জন্যই তাদের অপরাধ কম বলে ধরা যেতে পারে না৷ নির্ভয়ার ওপর যে অত্যাচার করা হয়েছে তাকে সুনামির মতোই ভয়াবহ আঘাত বলে অভিহিত করেন বিচারপতিরা৷''
মৃত্যুর আগে দিল্লি পুলিশের কাছে দু-বার জবানবন্দী দিয়েছিলেন নির্ভয়া৷ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া সামগ্রী, ডাক্তারি পরীক্ষা, সাক্ষ্য-প্রমাণ ইত্যাদির উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে৷ তাছাড়া অপরাধীদের ও মেয়েটির ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের মতো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতেও স্পষ্ট প্রমাণ, ঘটনার দিন তারা সেখানেই ছিল৷ নির্ভয়ার বুকে কামড়ের চিহ্ন এবং ‘ওডোন্টোলজি রিপোর্ট' এবং তাঁর গোপনাঙ্গে লোহার রড ঢোকানো এবং শরীরের ভেতর থেকে প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে বের করে আনার মতো ঘটনার উল্লেখও করেছেন বিচারপতিরা৷ রায় ঘোষণার আগে এদিন সকাল থেকেই তুমুল কৌতুহল ছিল৷ ভিড়ে ঠাসা ছিল আদালত চত্বর৷ নির্ভয়ার বাবা-মা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের ওপর তাঁদের ভরসা ছিল৷ দেরিতে হলেও অবশেষে তাঁরা সুবিচার পেয়েছেন৷ দোষী ছয় জনের অপরাধমূলক যড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যই প্রমাণিত হয়েছে৷ তবে মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলে এই রায়ের বিরোধিতা করেছেন বিপক্ষের আইনজীবি এ পি সিং৷ তাঁর দাবি, সমাজকে বার্তা দেওয়ার জন্য কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো যায় না৷ তবে শীর্ষ আদালতের এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে দিল্লির মহিলা কমিশন৷
২০১২-র ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর রাস্তায় চলন্ত বাসের মধ্যে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷ নৃশংস সেই ঘটনায় আঁতকে ওঠে গোটা দেশ৷ ১৩ দিন যমে-মানুষে টানাটানির পর ২৯ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরের এক হাসপাতালে নির্ভয়ার মৃত্যু হয়৷
তারপর সারা দেশ প্রতিবাদে মুখর হয়৷ অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ওঠে গোটা দেশজুড়ে৷ ২০১৪-র ১৩ মার্চ মুকেশ, পবন, বিনয় শর্মা এবং অক্ষয় কুমার সিংকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয় দিল্লি হাইকোর্ট৷ হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয় চার অভিযুক্ত৷
মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে আবেদন জানিয়েছিল অক্ষয়, পবন, বিনয় ও মুকেশরা৷ তবে সর্বোচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ডের সাজাই বহাল রাখল৷ সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকেই৷
রাজীব চক্রবর্তী, নতুনদিল্লি